আর এমন অপকর্মে জড়িত রয়েছে কুয়ালালামপুরের বাংলাদেশের হাইকমিশন কেন্দ্রিক একটি চক্র। সম্প্রতি কুয়ালালামপুর ঘুরে এমন অভিযোগের তথ্যই পাওয়া যায়।
পাসপোর্ট করতে হলে কত কিছু প্রয়োজন হয়। এই যেমন- জন্ম সনদ/জাতীয়তার সনদ, নাগরিকত্বের সনদ, ছবিসহ বিভিন্ন কাগজপত্রের সত্যায়ন। আরও দরকার হয় পুলিশ ভেরিফিকেশনের রিপোর্ট।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যক্তি বলেন, কিছুই লাগে না, শুধু টাকা দেবেন, আপনার বাসায় পাসপোর্ট পৌঁছে যাবে। আপনাকে স্বাক্ষরও দিতে হবে না। আপনি বিশ্বাস না করতে চাইলে- চলেন আমার সঙ্গে, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি। তবে শর্ত হচ্ছে আপনি আমার অথবা পাসপোর্টধারীর নাম প্রকাশ করতে পারবেন না।
হাইকমিশনের সামনেই কথা হয় এ প্রবাসী বাংলাদেশির সঙ্গে। ভুয়া পাসপোর্ট দেখানোর জন্য তিনি বুকিত বিনতানে যাওয়ার অনুরোধ করেন। তার কথা মতো বুকিত বিনতানে গেলে এক বাংলাদেশিকে ডেকে আনেন। যিনি ২৩শ’ রিঙ্গিত দিয়ে পাসপোর্ট করেছেন।
এই ব্যক্তি নদীপথে এসেছিলেন মালয়েশিয়া। এখন বাংলাদেশে ফিরে যাবেন। সে কারণে পাসপোর্ট করেছেন। তাকে কোথাও যেতে হয়নি। পাঁচদিনের মধ্যে পাসপোর্ট হাতে পেয়েছেন। অবাক করার মতো বিষয় হচ্ছে তাকে স্বাক্ষরও দিতে হয়নি। দালালই সব করে দিয়েছে।
কার মাধ্যমে কীভাবে পাসপোর্ট করেছেন সে বিষয়ে খোলাসা করতে রাজি হলেন না। তবে তিনি বললেন, ‘যান হাইকমিশন এলাকায়, সেখানেই সিন্ডিকেট আছে। শুনেছি ওরা নাকি মুকুলের লোক। এর বেশি জানি না। ’
বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায় ১৬ ফেব্রুয়ারি কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্টে গেলে। এয়ারপোর্টে যাওয়ার সময় কোতারায়ায় পরিচয় হয় মো. ইসমাইল নামে এক যুবকের সঙ্গে। তিনি নাকি চারবছর পর বাংলাদেশে ফিরছেন। মালয়েশিয়া গিয়েছিলেন ট্রলার যোগে।
দেশে ফিরছেন, তবে তার সঙ্গে কোনো লাগেজ নেই কেন- এমন প্রশ্ন করতেই মুচকি হেসে ইসমাইল বলেন, ‘এখানে আসার পথে ট্যাক্সিচালক ছিনতাই করে নিয়েছে। ’ কীভাবে ছিনতাই হলো? প্রশ্ন করলে অন্য কথা পাড়লেন ইসমাইল।
এয়ারপোর্টের প্লেনের জন্য অপেক্ষায় থাকাকালে ইসমাইলের পাশের চেয়ারে বসা একজনের কাছে জানতে চাইলেন- ‘এখানে কী লাগবে? আর কী জিজ্ঞাসাবাদ করবে। ওই ভদ্রলোক জবাব দিলেন, ‘এখানে পাসপোর্ট ও টিকিট লাগবে। জন্ম তারিখ, বাবা-মায়ের নাম ও ঠিকানা জিজ্ঞেস করতে পারে। ’
এবার অবাক করে দিয়ে ইসমাইল বললেন, ‘দেখেন তো আমার জন্ম তারিখ কত? মায়ের নাম কী দেওয়া আছে।
পাশে বসা ভদ্রলোক তাকে বললেন, ‘আপনি পড়তে পারেন না’। ইসমাইল উত্তর দিলেন, না। ভদ্রলোক এবার উল্টো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন- এখানে তো সুন্দর করে ইংরেজিতে স্বাক্ষর দেওয়া।
ইসমাইল এবার সরল স্বীকারোক্তি দিলেন, আমি তো কোথাও স্বাক্ষর করিনি। সাতদিন আগে পাসপোর্ট পেয়েছি। খরচ হয়েছে ২৪শ’ রিঙ্গিত (প্রায় তেতাল্লিশ হাজার টাকা)।
হাত বাড়িয়ে পাসপোর্ট দিয়ে বললেন, দেখেন তো ভাই আমার পাসপোর্টটি ঠিক আছে কিনা? এইটা দিয়ে বাংলাদেশে যেতে কোনো সমস্যা হবে কিনা?
হাতে নিয়ে পাসপোর্ট দেখে অবাক হওয়া ছাড়া উপায় ছিলো না। সেই পুরনো হাতে লেখা পাসপোর্ট। তাতে মায়ের নাম ভুল। আবার যিনি পাসপোর্ট লিখেছেন একই হাতেই পাসপোর্টধারীর স্বাক্ষরও করে দিয়েছেন। যা দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো।
পাসপোর্টের তারিখ দেওয়া হয়েছে অনেক পুরনো। পাসপোর্ট সরবরাহের তারিখ ৩০ ডিসেম্বর ২০১২। আর মেয়াদ দেওয়া হয়েছে ৩১ মার্চ ২০১৫ পর্যন্ত। স্থায়ী নিবাসের পৃষ্ঠায় গ্রাম মোন্দারডিল, থানা টেকনাফ, জেলা কক্সবাজার লেখা।
পাসপোর্টের মেয়াদ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ইসমাইল বলেন, আমি তো আটদিন আগে পাসপোর্ট করেছি। তাহলে ডেট শেষ হবে কীভাবে?
ইসমাইলের মতো আরও কয়েকজনের দেখা মেলে কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্টে। যারা ১৭ ফেব্রুয়ারির ফ্লাইটে বাংলাদেশে আসেন। তারা কেউই পাসপোর্টে স্বাক্ষরও করেননি। একজনের সঙ্গে কথা হয়, যিনি সঠিকভাবে বাংলাও বলতে পারছিলেন না। ঠিকানা জানতে চাইলে বললেন উখিয়া। গ্রামের নাম জানতে চাইলে মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে চলে গেলেন।
এই পদ্ধতিতে যেমন মালয়েশিয়ায় অবস্থানকারী অবৈধ অভিবাসীরা বাংলাদেশে ফিরছেন। এই ফাঁক দিয়ে রোহিঙ্গারাও বাংলাদেশে ঢুকছে।
এসব অনৈতিক কারবারের বিষয়ে সবার অঙুল মালয়েশিয়া আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতার বিরুদ্ধে। এমন ঘটনায় আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
বাংলাদেশ সময়: ০৯১৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১৭
এসআই/টিআই/জেডএম