চাঁপাইনবাবগঞ্জ: চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে একতরফা ভালোবাসার বলি হন জান্নাতি বেগম (১৮) নামে এক গৃহবধূ। তার মৃত্যুর পর আদালতের নির্দেশে মামলা দায়ের হলেও এখনো গ্রেফতার হয়নি আসামিরা।
নিহতের পরিবার আসামিকে গ্রেফতারের দাবিতে দ্বারে দ্বারে ঘুরলেও এখনো কোনো আসামি গ্রেফতার হয়নি। যদিও পুলিশের দাবি ময়নাতদন্তের রিপোর্ট না পাওয়ায় মামলাটি নিয়ে এগুনো যাচ্ছে না।
আর অসহায় পরিবার মেয়ে হত্যার বিচার চেয়ে শনিবার সন্ধ্যায় শিবগঞ্জ পৌর এলাকার ডাক বাংলো চত্বরে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য দিয়ে দাবি করেন আসামিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং মামলাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহের তদবীর করছে।
নিহত জান্নাতির মা নিরক্ষর হওয়ায় মায়ের পক্ষে সংবাদ সম্মেলনে জান্নাতির খালা মোসলেমা অভিযোগ করে বলেন, মরদেহ উদ্ধারের দিন পুলিশ তার বোনের নিরক্ষরতার সুযোগ নিয়ে একটি কাগজে টিপ সই নিয়ে মেয়ে হত্যার ঘটনায় মামলা দায়েরের পথ রুদ্ধ করে দেয়। পুলিশ মাকে বাদী করে দায়ের করে অপমৃত্যুর মামলা। সেইসঙ্গে জব্দ করা হয় জান্নাতির বাঁচতে চেয়ে ফোন করা সেই ০১৭৪৪৬৩৩৯১০ নম্বরের সিমযুক্ত মোবাইল ফোন ও পোশাক। সুরতহাল রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় যৌনিপথে ছিল না কোনো বীর্য।
এর আগে উপজেলার চর ভবানীপুর গ্রামের আলমের ছেলে আলামিন তাকে কৌশলে আমবাগানে নিয়ে ধর্ষণ করে। এ সময় কৌশলে জান্নাতি তার চাচাত ভাইকে ফোনে বাঁচানোর আকুতি জানালে সেই ফোনও কেড়ে নেয় আলামিন ও তার বন্ধুরা। পরে আরও কয়েকজন পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে গাছে ফাঁসি দেওয়ার মত করে ঝুলিয়ে রাখে।
নিহত গৃহবধূ উপজেলার দুর্লভপুর ইউনিয়নের পিয়ালীমারী গ্রামের জেমের স্ত্রী ও মনাকষা ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামের নাজির হোসেনের মেয়ে।
নিহতের মা ও মামলার বাদী সুরেফা বেগমের অভিযোগ-তার ভাসুরের ছেলে আলামিন জান্নাতিকে লেখাপড়া করার সময় থেকেই বিরক্ত করত। পারিবারিকভাবে এর সমাধান না হওয়ায় একই এলাকায় বিয়ে দেন মেয়েকে। কিন্তু আলামিন মেয়ের স্বামীর বাড়িতে বিভিন্নভাবে কথা লাগালে সে বিয়ে ভেঙে যায়। পরে আবার মেয়ের বিয়ে দেন পিয়ালীমারিতে। দ্বিতীয় বিয়ের পর মেয়েকে না পেয়ে কৌশলে ডেকে তার মেয়েকে নির্যাতন করে হত্যা করে সে। এ ঘটনায় পুলিশের নিষ্ক্রিয়তাসহ ঘটনার আদ্যোপান্ত সব জেনেও পুলিশ তদন্তের নামে কালক্ষেপণ করছে এবং আসামিদের গ্রেফতার করছে না বলে দাবি তার।
মামলার বাদী আরও জানান, মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় থানায় অপমৃত্যুর মামলা থাকায় প্রথমে মামলা গ্রহণ করেনি পুলিশ। পরে ২ নভেম্বর আলামিনকে প্রধান আসামি করে পাঁচজনের বিরুদ্ধে চাঁপাইনবাবগঞ্জ আদালতে মামলার আবেদন করলে শিবগঞ্জ থানার ওসিকে মামলাটি রেকর্ডের নির্দেশ দেন আদালত। ৯ নভেম্বর শিবগঞ্জ থানার ওসি মামলাটি (মামলা নম্বর ২২) রেকর্ড করেন। তবে মামলার ৫০ দিন পেরিয়ে গেলেও কোনো আসামিকে গ্রেফতার করেনি পুলিশ।
মামলার সাক্ষী ও জান্নাতির চাচাতো ভাই আহসান হাবিব বলেন, ঘটনার দিন (১ অক্টোবর) রাত ১২টা ৩৮ মিনিটের দিকে জান্নাতি মোবাইল ফোনে আমাকে উদ্ধার করার কথা বললেও আর কথা বলা সম্ভব হয়নি। হত্যার কয়েক ঘণ্টা আগে জান্নাতি ফোনে জানায় আমাকে বাঁচাও, ওরা আমাকে ধর্ষণ করেছে এখন মেরে ফেলার জন্য নিয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরও জানান, ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে জান্নাতি তার বাবার বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয় এবং রাত ১১টার দিকে নিখোঁজের বিষয়টি জানাজানি হয়। পরদিন সকালে গোপালপুর কবরস্থানের কাছে আম বাগানের একটি গাছ থেকে তার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
নিহতের চাচা অকিল হোসেন জানান, আসামিরা এলাকার চিহ্নিত বখাটে। এদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী। এর আগে শিংনগর গ্রামে এক মেয়েকে উত্ত্যক্ত করার জন্য ৫ নম্বর আসামি রহিমকে গণপিটুনি দেয় স্থানীয় জনতা। এছাড়া গত সপ্তাহে একই এলাকায় আরেক মেয়েকে উত্ত্যক্ত করার জেরে ২ নম্বর আসামি গোলাবকেও আটক করেছিল এলাকাবাসী।
নিহতের বাবা নাজির হোসেন জানান, আলামিন ও তার সহযোগী আসামিরা মেয়েকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে আত্মহত্যার প্ররোচনা চালায়। আর সেটি বাস্তবায়নের জন্য পুলিশ প্রথমে তার স্ত্রীকে দিয়ে কৌশলে অপমৃত্যুর মামলা করিয়ে সুরতহাল রিপোর্ট আসামিদের পক্ষে পাঠায়।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত নিহতের নানি এবং প্রধান আসামি আলামিনের দাদি জরিনা বেগম জানান, ফোনে তার নাতিকে এ জঘন্য ঘটনার ব্যাখ্যা চাইলে নাতি জান্নাতিকে বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করলেও হত্যার বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে ফোনের সংযোগ কেটে দেয়।
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত আলামিন ও তার বাবা আলমের ব্যবহৃত ফোন নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তাদের ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। পরে বাড়ি গিয়ে তাদের না পাওয়া গেলেও স্বজনদের দেওয়া ০১৭০৭৩৩০২৯৫ নম্বরে যোগাযোগ করা হলে ভুল নম্বর বলে ফোনটি কেটে দেওয়া হয়।
এ ব্যাপারে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও শিবগঞ্জ থানার ওসি (তদন্ত) সুকোমল চন্দ্র দেবনাথ জানান, আসামিদের প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ানোর অভিযোগ সঠিক নয়। তবে আসামিদের হয়রানি না করার জন্য ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা হচ্ছে। ময়নাতদন্ত রিপোর্টে আসামিরা অভিযুক্ত হলেই তাদের গ্রেফতার ও চার্জশিট দেওয়া হবে। ৫০ দিনেও ময়নাতদন্ত রিপোর্ট কেন পাওয়া যাচ্ছে না এবং কেন মামলা নেওয়া হয়নি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা মেডিকেলের ব্যাপার। আর একই ঘটনায় একটি মামলা থাকলে আর একটি নেওয়া যায় না। ঘটনার সত্যতা মিললে অপমৃত্যুর মামলাটি হত্যা মামলায় পরিণত হবে।
তিনি আরও জানান, পরবর্তীতে দায়ের করা মামলাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনসহ ৩২৩ ও ৩০৭ ধারায়।
অপরদিকে বাদীপক্ষের আইনজীবী সাহিনুল ইসলাম জানান, পুলিশ মামলা দায়েরের পরই আসামিদের ধরতে পারে। আসামি না ধরাটা রহস্যজনক। পুলিশের দায়িত্ব একটি ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধারের পর তারা অপমৃত্যু মামলা করবে। কিন্তু এখানে মূল ঘটনাকে আড়াল করতে ও বাদীর মামলা না নিতে বাদীকে দিয়ে কৌশলে অপমৃত্যুর মামলা করানো হয়েছে।
তিনি আরও জানান, ৩ নভেম্বর আদালত এ মামলায় রিপোর্ট দাখিলের জন্য থানা পুলিশকে নির্দেশ দিলেও এখনও পুলিশের রিপোর্ট আদালতে দেয়নি।
বাংলাদেশ সময়: ১৮১৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৮, ২০২৩
আরএ