বগুড়া: বাঙালি জীবনের সঙ্গে মেলার যোগ দীর্ঘকালের। এ সম্পর্ক নিবিড় ও আত্মিক।
প্রায় চারশ বছরের গ্রামীণ ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে বগুড়ায় প্রতি বছর মাঘের শেষ বুধবার অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহ্যবাহী ‘পোড়াদহ’ মেলা। বগুড়ার গাবতলী উপজেলার ইছামতি নদীর তীরে পোড়াদহ এলাকায় এ মেলার আয়োজন করা হয়। এবারের মেলা আয়োজিত হচ্ছে বুধবার (১৫ ফেব্রুয়ারি)। পোড়াদহ মেলার পরদিন একই স্থানে বসবে বউমেলা।
মেলা শব্দটি শুনলেই মনে এক ধরনের আনন্দের উচ্ছ্বাস জেগে ওঠে। আর ‘পোড়াদহ’ মেলা সেই আনন্দ ও উচ্ছ্বাস আরও একধাপ যেন বাড়িয়ে দেয়। মেলাকে ঘিরে জামাই-বউ ও স্বজনদের নিমন্ত্রণ জানানো হয়। নিমন্ত্রণ দেওয়ার ক্ষেত্রে নতুন-পুরনো বিবেচনা করা হয় না। কারণ, এ মেলা শত শত বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ। সেই ঐতিহ্য ধারণ করে সবাই মেতে ওঠেন বাঁধভাঙা উৎসব-উচ্ছ্বাসে।
মঙ্গলবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) উপজেলার পোড়াদহ ও মহিষাবান গ্রামের শাজাহান আলী, সাবেদ মিয়া, আব্দুল হান্নানসহ বেশ কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তির সঙ্গে আলাপচারিতায় ঐতিহ্যবাহী এ মেলা সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়।
জানা যায়, বগুড়া সদর থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার পূর্বে ইছামতির তীরে পোড়াদহ এলাকায় এ মেলা বসে। মেলাটি সবার কাছে ‘পোড়াদহ’ মেলা নামেই সর্বাধিক পরিচিত। প্রায় চারশ বছর আগের ঘটনা। মেলাস্থলে ছিল একটি বিশাল বটবৃক্ষ। সেখানে একদিন হঠাৎ এক সন্ন্যাসীর আবির্ভাব ঘটে। পরে সেখানে আশ্রম তৈরি করেন সন্ন্যাসীরা। এক পর্যায়ে স্থানটি পূণ্যস্থানে পরিণত হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে।
প্রতি বছর মাঘের শেষ বুধবার ওই স্থানে সন্ন্যাসী পূজার আয়োজন করে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। সমাগত হন দূর-দূরান্তের ভক্তরা। কালের আবর্তে স্থানটিতে লোকজনের উপস্থিতি বাড়তেই থাকে। এভাবে গোড়াপত্তন ঘটে পোড়াদহ মেলার। ধর্মের গণ্ডি পেরিয়ে সব ধর্মের মানুষের মেলবন্ধনে পরিণত হয় এই মেলা। মেলাটি একদিনের। তবে উৎসবের আমেজ থাকে সপ্তাহব্যাপী। নতুন জামাই-বউ ও স্বজনরা মিলে এ উৎসব করেন।
রকমারি জাতের মাছ এ মেলার প্রধান আকর্ষণ। বুধবার ভোর রাতের আগেই আড়তে আনা হয় বড় আকারের মাছগুলো। আর ভোর রাত থেকেই আড়তে আড়তে ছুটে যান খুচরা ব্যবসায়ীরা। চাহিদা অনুযায়ী তারা মাছ কেনেন। পরে মাছের পসরা সাজিয়ে দোকানে দোকানে জেঁকে বসেন এসব ব্যবসায়ীরা। দিনভর দোকানগুলোয় চলে ধুমছে কেনাকাটা।
বাঘাইড়, রুই, কাতলা, মৃগেল, বোয়াল, সিলভার কার্প, বিগহেড, কালবাউস, পাঙ্গাসসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ পাওয়া যায় এ মেলায়। মেলায় দুই থেকে তিন মণ ওজনের বাঘাইড়ও পাওয়া যায়। পাওয়া যায় পনের থেকে বিশ কেজি ওজনের রুই, কাতলা, পাঙ্গাস। তবে গত বছর মহাবিপন্ন বাঘাইড় মাছ প্রদর্শন ও বিক্রি বন্ধ করতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্রিদের চিঠি দিয়েছে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট।
চিঠিতে বলা হয়, বাঘাইড় মাছ একটি মহাবিপন্ন প্রাণী। তাই পোড়াদহ মেলায় মহাবিপন্ন বাঘাইড় কেনা-বেচা বন্ধ করতে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করা হলো। বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০০২ অনুযায়ী মেলায় মহাবিপন্ন বাঘাইড় কেনা-বেচা করা হলে এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।
এ মেলায় বাহারি মিষ্টান্ন সামগ্রী আরেক আকর্ষণ। মাছ আকৃতির মিষ্টি, রসগোল্লা, সন্দেশ, জিলাপি, নিমকি, তিলের নাড়ু, খই, শুকনা মিষ্টি পাওয়া যায়। ৫ থেকে ১০ কেজি ওজনের মিষ্টি পোড়াদহ মেলার অন্যতম আকর্ষণ।
মেলায় মাছ, মিষ্টি এছাড়াও বাহারি ডিজাইনের কসমেটিকস, খেলনা, গিফট সামগ্রী, চুড়ি, কানের দুল, মালা, কাজল, মেকআপ বক্স, ব্যাট, বল, ভিডিও গেমসসহ নানা ধরনের প্রসাধনী ও খেলনা সামগ্রী পাওয়া যায়। এছাড়া এ মেলায় পাওয়া যায় কাঠের, স্টিল ও লোহার বিভিন্ন আসবাবপত্র।
মেলায় দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন এসে পণ্য সাজিয়ে মেলাকে আকর্ষণীয় করে তোলেন। মেলা শুধু বেচাকেনার স্থান নয়। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা ক্রেতা-দর্শনার্থীদের মধ্যে আলাপ-পরিচয়, বন্ধুত্ব এমনকি আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একসঙ্গে গল্প-গুজব, খাওয়া-দাওয়া, অনুষ্ঠান উপভোগ করার মধ্যদিয়ে পারস্পরিক সৌহার্দ্য সম্প্রীতি ভ্রাতৃত্ব বন্ধন দৃঢ় হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৫১১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২৩
কেইউএ/এমজেএফ