ঢাকা: অভাবের সংসারে হাল ধরতে মাস দুয়েক আগে বাড়ি থেকে ঢাকায় এসেছিলেন ইয়াসিন (২৬)। মাত্র ১২ হাজার টাকা বেতনে চাকরি নিয়েছিলেন নানার (মায়ের মামা) দোকানে।
মঙ্গলবার (৭ মার্চ) রাজধানীর গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটনায় গুরুতর আহত হন ইয়াসিন। তিনি ওই মার্কেটের বেসমেন্টে অবস্থিত বাংলাদেশ স্যানেটারিতে কাজ করতেন। এই ঘটনায় তার শরীরের ৫০ শতাংশ পুড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার শ্বাসনালি। বর্তমানে তিনি শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) লাইফ সাপোর্টে রয়েছেন।
ইয়াসিনের দুর্ঘটনার খবর শোনার পর মঙ্গলবার রাতেই ঢাকায় ছুটে আসেন মা ঝর্না বেগম ও বাবা আব্দুল খালেক। কিন্তু মঙ্গলবার সারারাত ও বুধবার সারাদিন আইসিইউর সামনে অপেক্ষা করেও বুকের ধনকে একটিবার চোখে দেখতে পারেননি তারা। তাই পরিচিত কাউকে দেখলেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানাচ্ছেন ছেলেকে দেখার আকুতি।
পরিবারসূত্রে জানা যায়, ইয়াসিনের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার দরবেশপুরে। থাকতেন রাজধানীর মগবাজারে মামার বাসায়। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে ইয়াসিন তৃতীয়। বড় ভাই সৌদি আরবে টাইলসের কাজ করেন, বাবা এলাকায় একটি বেসরকারি কোম্পানিতে রঙের কাজ করেন। মা গৃহিণী ও বাকি দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে।
বুধবার বিকেলে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের চারতলায় অবস্থিত আইসিইউর সামনে গিয়ে দেখা যায়, ছেলেকে একবার দেখার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছেন ঝর্না বেগম। ইনস্টিটিউটের নার্স বা ওয়ার্ডবয়কে দেখলেই ছুটে গিয়ে আবদার জানাচ্ছেন ছেলের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
ঝর্না বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বাংলানিউজকে বলেন, গতকাল সন্ধ্যায় খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ছুটে আসছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত ছেলেকে একবার চোখের দেখা দেখতে পারিনি। আমার বুকের ধন দুই মাস আগে চাকরির জন্য আসছিল। সেই ছেলেই এখন হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছে।
ইয়াসিনের বাবা আব্দুল খালেক বলেন, গতকাল সন্ধ্যার পর রওনা দিয়েছি। রাত ১২টার সময় হাসপাতালে পৌঁছাই। তারপর থেকে অপেক্ষা করছি। কখন ছেলেকে একবার দেখতে পারব, কে জানে।
ইয়াসিনের মামি মমতাজ বেগম বলেন, ইয়াসিন আমাদের বাসায় থেকেই দোকানে যেত। প্রতিদিন সকাল ৯টায় বের হতো, ফিরত রাত ৯টায়। হঠাৎ কী থেকে কি যে হয়ে গেল।
তিনি আরও বলেন, আমি গতকাল একবার ইয়াসিনকে দেখার সুযোগ পাই। ডাক্তার বলছেন, রোগীর অবস্থা বেশি ভালো না, আল্লাহকে ডাকতে।
ইয়াসিনের মামা মো. আজিম বলেন, আমার মামার দোকানেই ভাগনেকে চাকরি দিয়েছিলাম। গতকাল বিস্ফোরণের খবর শোনার পর সঙ্গে সঙ্গে গুলিস্তানে ছুটে আসি। এসে দেখি ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ সদস্যে পুরো এলাকা ভরে আছে। সেখানে ভাগনেকে খুঁজে না পেয়ে পরে ঢাকা মেডিকেলে আসি। অনেক খোঁজাখুঁজির পর ভাগনেকে পাই।
ইয়াসিনের সঙ্গে কাজ ওই দোকানে কাজ করতেন স্বপন ও মির্জা। তাদের মধ্যে স্বপন এখন পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছেন। গুরুতর আহত হয়ে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের এইচডিইউতে ভর্তি আছেন মির্জা।
বুধবার দুপুরে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়কারী অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন সাংবাদিকদের জানান, বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি কেউই শঙ্কামুক্ত নয়। চিকিৎসাধীন প্রত্যেকের শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। কারো ৮০ শতাংশ, কারো ৯০ শতাংশ, কারো ৫০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এই ঘটনায় আমাদের এখানে ১১ জন রোগী এসেছিলেন। এর মধ্যে একজনকে বার্ন না থাকার কারণে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। বাকি ১০ জন এখানে চিকিৎসাধীন আছেন। চিকিৎসাধীন ১০ জনের মধ্যে তিনজন নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন। তাদের দুজনকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। বাকি ৭ জন এইচডিইউতে চিকিৎসাধীন।
মঙ্গলবার বিকেল ৫টার দিকে গুলিস্তানের বিআরটিসি বাস কাউন্টারের পাশে সিদ্দিকবাজারে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। এতে এখন পর্যন্ত ১৯ জন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছে শতাধিক। আহতদের ঢামেকসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ২১০৬ ঘণ্টা, মার্চ ৮, ২০২৩
এসসি/আরএইচ