ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

রাজশাহী নভোথিয়েটার

ডোম স্থাপনে শর্ত ভঙ্গের অভিযোগ, অস্বীকার ঠিকাদারের

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১০৪ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০২৩
ডোম স্থাপনে শর্ত ভঙ্গের অভিযোগ, অস্বীকার ঠিকাদারের

রাজশাহী: রাজশাহীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটারে ইনার ডোম স্থাপন নিয়ে শর্ত ভঙ্গের অভিযোগ উঠেছে। তবে এমন অভিযোগ অমূলক এবং মিথ্যাচার বলে দাবি করেছে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান গণপূর্ত অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

তারা এ ব্যাপারে নিজেদের ব্যখ্যাও তুলে ধরেছে।

সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে মহাকাশ-সম্পর্কিত জ্ঞানের বিশাল ভাণ্ডার তৈরি করতে রাজশাহীতেও নির্মাণ করা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটার। প্রথমে রাজশাহীতে দেশের দ্বিতীয় নভোথিয়েটার নির্মাণের প্রকল্পটি নিয়েছিল সিটি করপোরেশন। পরে এটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব নেয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

২২২ কোটি ৩ লাখ টাকা ব্যয় ধরে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটার, রাজশাহী স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পটি ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় পাস হয়। এর আগে ২০১৫ সালের আগস্টে প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় অনুমোদন পায়। আর ওই বছরের ডিসেম্বরে মাসেই একনেকে যায় প্রকল্পটি।

বর্তমানে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে রাজশাহী গণপূর্ত বিভাগ-১। আর ‘ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড’ নামে ঢাকার একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দরপত্রের মাধ্যমে এটি নির্মাণের কাজ পেয়েছে। এরইমধ্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে মূল অবকাঠামো। নভোথিয়েটারের চারতলা অফিস ব্লক ও ৩৯ হাজার ৮০০ বর্গফুট আয়তনের প্ল্যানেটোরিয়াম ব্লকের নির্মাণ কাজও শেষ হয়ে গেছে। অবশিষ্ট যে কাজ আছে তা আগামী এপ্রিল মাসের মধ্যেই শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। যদিও সরকারের এই মেগা প্রকল্পটি শেষ করার জন্য ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ অবশিষ্ট আছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

রাজশাহীর শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান কেন্দ্রীয় উদ্যান ও চিড়িয়াখানায় ২ দশমিক ৩০ একর জায়গাতে নির্মাণ করা হচ্ছে দেশের দ্বিতীয় এই নভোথিয়েটার। রাজধানী ঢাকার বাইরে প্রথম রাজশাহীতেই এর নির্মাণকাজে হাত দেওয়া হয়। করোনা মহামারির ধাক্কায় নভোথিয়েটারটির নির্মাণকাজের গতি কমে যায়। তবে মহামারির পর কাজ এগিয়ে চলছে দ্রুত গতিতেই।

এখন আধুনিক প্রযুক্তির ‘ডোম’ বসানোর কাজ শেষ হলেই উন্মুক্ত হবে দ্বিতীয় এই নভোথিয়েটারের দুয়ার। তবে এর আগেই নভোথিয়েটারের ইনার ডোম স্থাপন নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন উঠেছে। ডাবল রিবেট ও সিমলেস নয়, এমন জয়েন্ট সিস্টেমের ইনার ডোম বসানোর হচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে দরপত্রে একক লাইন রিবেট ও সিমলেস জয়েন্ট সিস্টেম ডোম বসানোর বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। বলা হচ্ছে, কাজ বাস্তবায়নকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সেটা মানছে না। এমনকি দরপত্রে উল্লেখিত আকার পরিবর্তন করে ইনার ডোম স্থাপনের অভিযোগও উঠেছে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।

দরপত্রের স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার ঢাকার আদলে ইনার (অভ্যন্তরীণ) ডোম নির্মাণের জন্য সিঙ্গেল লাইন রিবেট ও সিমলেস ওভারল্যাপ জয়েন্ট সিস্টেম পদ্ধতি ব্যবহার করার কথা। যা বর্তমান বিশ্বের সর্বাধুনিক ও টেকসই একটি টেকনোলজি।

কিন্তু দরপত্রের শর্ত উপেক্ষা করে ঠিকাদারের নিয়োগকৃত ইনার ডোম প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান স্পিটজের তৈরি ডাবল রিবেট ও সিমলেস নয় এমন জয়েন্ট সিস্টেমের ইনার ডোম বসাতে যাচ্ছে রাজশাহীতে। এছাড়া দরপত্রে উল্লেখিত আকার অনুযায়ী আউটার ডোম সরবরাহ করা হলেও ইনার ডোমের আকার পরিবর্তন করে আমদানি করেছে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, নক্ষত্র, সূর্য ও পৃথিবী নভোথিয়েটারের ডোমের স্কিনে প্রদর্শন করা হয়। এ কারণে রাজশাহীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটারে অন্যান্য প্রযুক্তির তুলনায় আধুনিক প্রযুক্তির একক লাইন রিবেট ও সিমলেস জয়েন্ট সিস্টেম ডোম বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। বাস্তবায়নকারী ঠিকাদারী ওই প্রতিষ্ঠান সিঙ্গেল রিবেট এবং সিমলেস ওভারল্যাপ ব্যবহার না করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান স্পিটজ এর তৈরি তুলনামূলক অজনপ্রিয় ও পুরনো প্রযুক্তি হওয়ায় সস্তা দামের এই ডোম বসাবে।

অথচ আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটার প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রীর একটি স্বপ্নের প্রকল্প। এই ধরনের ডোম সরবরাহ করা হলে কোটি কোটি টাকা গচ্চা যাওয়ার পাশাপাশি সরকারের প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাধাগ্রস্ত হবে।

তবে এমন অভিযোগ অমূলক। ভিন্নভাবে বুঝিয়ে বিষয়টি নিয়ে মিথ্যাচার করা হচ্ছে বলে দাবি করেছে গণপূর্ত-১ ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

রাজশাহী গণপূর্ত বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী হারুন-অর-রশীদ বলেন, রাজশাহী বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটারের নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় গণপূর্তের মাধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে এই কাজটি বাস্তবায়ন করছে। তারা মূলত ভবনের অবকাঠামোগত কাজ করেন। আর সমস্ত ইকুইপমেন্ট কেনা, স্থাপান এবং তা সক্রিয়করণ করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তাই ভবন নির্মাণ ছাড়া তারা আর অন্য কোনো বিষয় দেখেন না। এটি পিডির (প্রকল্প পরিচালক) মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সরাসরি মনিটরিং করে।

তবে ইনার ডোম স্থাপন নিয়ে যেই অভিযোগ উঠেছে তা সত্য নয়। গণমাধ্যমকে বিভ্রান্ত করতে ভুল তথ্য দিয়ে মিথ্যা অভিযোগ করা হয়েছে। এই ব্যাপার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সুনির্দিষ্টভাবে বক্তব্য দিয়েছেন বলেও উল্লেখ করেন রাজশাহী গণপূর্ত বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী।

এদিকে, এ সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড এবং স্পেকট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড জানিয়েছে, অভিযোগের তথ্যগুলো বিভ্রান্তিকর। মূলত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটার, রাজশাহীতে গণপূর্ত বিভাগ-১ কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ইনার এবং অউটার ডোমের দরপত্রে ন্যানোসিম অথবা আলট্রাসিম প্যানেল সরবরাহ করার শর্ত উল্লেখ ছিল।

শর্তানুসারে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘স্পেকট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স লি. ও ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লি. জেভি’ বিশ্বের সর্বাধুনিক প্লানেটারিয়াম এবং প্রজেকশন সিস্টেম প্রস্তুতকারী যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান স্পিটজ ইনকর্পোরেশনের তৈরি ন্যানোসিম প্যানেলের ইনার ডোম সরবরাহ করার প্রস্তাব দাখিল করে। ন্যানোসিম টেকনোলজি একটি সর্বাধুনিক প্রজেকশন প্যানেল সিস্টেম যেখানে প্রতিটি ইলেক্ট্রোস্ট্যাটিক্যালি পাউডার-কোটেড সমতল ও মসৃণ প্যানেল একটি আরেকটির সাথে মুখোমুখি জয়েন্টের মাধ্যমে একটি অনবদ্য সিমলেস (দাগবিহীন) প্রজেকশন সার্ফেস সৃষ্টি করে।

এই প্যানেলগুলো এক ধরনের বিশেষ কাউন্টারসাঙ্ক রিভেটের মাধ্যমে ফ্রেমের সাথে সংযুক্ত করা হয়। এই রিভেট গুলো ন্যানোসিম প্যানেলের ছিদ্রের সাথে একেবারেই মিশে যায় এবং আপাতদৃষ্টিতে কোন রিভেটের অস্তিত্বই টের পাওয়া যায় না, যা একটি প্রজেকশন সার্ফেসের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এইসব বিশেষ গুনাগুণের কারণে বিশ্বব্যাপী ২৫০টিরও বেশি ন্যানোসিম প্রজেকশন ডোম ইনস্টল করা হয়েছে, যা স্পিটজের প্রায় ৭০ বছরের বেশি সময়ে ধরে অর্জিত কারিগরি দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ফসল।

স্পিটজ ইতোমধ্যে সারা বিশ্বের প্রায় ৫০টি দেশে দুই হাজারেরও বেশি থিয়েটারে তাদের পণ্য ও প্রযুক্তি সরবরাহ করেছে। দরপত্রের সাথে দাখিলকৃত সকল ড্রইং ও টেকনিক্যাল ডকুমেন্টস যাচাই বাছাইয়ের মাধ্যমে এসব বিষয় অনুধাবন পূর্বক সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ‘স্পেকট্রা ইঞ্জিনিয়ারস লি. ও ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লি. জেভি’ কে ইনার ও আউটার ডোম সরবরাহের কাজ দিয়েছে।

অপরদিকে অন্তর্জাতিক বাজারে ২০ থেকে ২৫ বছরের পুরনো প্রজেকশন ডোম সিস্টেম রয়েছে যেগুলো প্রজেকশন প্যানেলের জয়েন্টের লাইন অদৃশ্যমান করার চেষ্টায় প্যানেল ওভারল্যাপিং এর মাধ্যমে তৈরি করা হয়। এছাড়া ইলেক্ট্রোস্ট্যাটিক্যালি পাউডার-কোটিংয়ের পরিবর্তে সাধারণ রিফ্লেক্টিভ পেইন্ট ব্যাবহার করে হয়।

এই সকল তুলনামূলক সস্তা এবং পুরনো ডোম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটার, রাজশাহীতে সরবরাহ না করতে পারায় দেশীয় কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবসা হুমকির সম্মখীন হয়েছে বলে মনে করছে এবং গণমাধ্যমে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও স্পিটজ ইনকর্পোরেশন তথা সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিকর তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির ব্যাখ্যায় আরও বলা হয়, এই একই চক্র বরিশাল নভোথিয়েটারের আউটার ও ইনার ডোম প্রস্ততকারী প্রতিষ্ঠান নিয়োগের দরপত্র নিয়েও নানা মিথ্যাচার ও বিভ্রান্তিকর গুজব ছড়াচ্ছে এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিভাগের কর্মকর্তাদের বিষয়ে মানহানিকর বক্তব্য উপস্থাপন করছে। মিথ্যা, ভিত্তিহীন এবং ভুল তথ্য উপস্থাপন করে প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়োজিত সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং সরকারে বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানোর মাধ্যমে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার চক্রান্ত করছে।

ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড এবং স্পেকট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড বিগত ৪০ বছরে ধরে বাংলাদেশের অত্যন্ত স্বনামধন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ইতিমধ্যে উভয় প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন যাবত বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নির্মাণ ও গুণগত মানসম্পন্ন অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সরবরাহের কাজ সফলভাবে এবং সুনামের সাথে শেষ করেছে বলে উল্লেখ করা হয় ওই ব্যাখ্যায়।

বাংলাদেশ সময়: ২০৩৯ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০২৩
এসএস/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।