ঢাকা: নারীর গৃহস্থালি কাজের আর্থিক মূল্য রাষ্ট্রীয়ভাবে নিরূপন ও স্বীকৃতি প্রদান, সরকারিভাবে ডে -কেয়ার সেন্টার ও কর্মজীবী নারী হোস্টেল নির্মাণ এবং নারীর স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে বাজেট বরাদ্দের দাবি জানিয়েছে সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম।
সোমবার (২৯ মে) জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আয়োজিত সমাবেশে এসব দাবি জানান সংগঠনটির নেতারা।
সমাবেশে বক্তারা বলেন, পৃথিবীতে এমন কোনো কাজ নেই, যার ফলাফল নেই। কাজ ছোট হোক বা বড় হোক তার প্রভাব পড়বেই। কিন্তু এমন অনেক কাজ আছে, যে কাজের ফলাফল ছাড়া দৈনন্দিন জীবন অচল হয়ে পড়ে। মানুষের শারীরিক, মানসিক, সাংস্কৃতিক জীবন বিকশিত হওয়া তো দূরের কথা, টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু সে কাজের কোনো স্বীকৃতি ও মর্যাদা নেই। এমনকি অনেক সময় সে কাজকে তাচ্ছিল্য করা হয়। এমনকি নেই কোনো পারিশ্রমিকও। এ স্বীকৃতিবিহীন, মর্যাদাবিহীন, মজুরিবিহীন কাজের নাম গৃহস্থালি কাজ। আর এ কাজের ৮০ ভাগের বেশি করেন নারীরা। উদয়াস্ত ক্লান্তিকর এ গৃহস্থালি কাজ ছাড়া সমাজ ও পরিবার টিকে থাকা অসম্ভব।
তারা আরও বলেন, নারীর কাজের অর্থনৈতিক অবদান প্রধানত তিন ভাগে বিভক্ত। প্রথমত, মজুরির বিনিময়ে কাজ এবং টাকা উপার্জনের জন্য স্বনিয়োজিত কাজ, যা জিডিপির হিসেবে যুক্ত হয় । দ্বিতীয়ত, নারীর মজুরিবিহীন কিছু পারিবারিক কাজ যেমন হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল পালন করে বিক্রি করা ইত্যাদি, এর আর্থিক মূল্য জিডিপিতে যুক্ত হয় । তৃতীয়ত, নারীর গৃহস্থালি কাজ, যার বাজার মূল্য বা বিনিময় মূল্য নেই, যা বাজারজাত করা যায় না, জিডিপিতে যুক্ত হয় না, এমনকি শ্রমশক্তি হিসেবেও গণ্য হয় না।
তারা বলেন, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর গৃহস্থালি কাজের স্বীকৃতি নেই বলে পরিবারে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে গৃহিণী নারীদের অংশগ্রহণ তার স্বামী বা পরিবারের অন্য সদস্যরা খুব একটা গ্রহণ করে না। অর্থাৎ, সংসারে নারীদের দায়িত্ব যত আছে অধিকার সে পরিমাণে নেই। বিশ্বের অনেক দেশেই বিবাহ বিচ্ছেদের পর স্বামী-স্ত্রীর মাঝে সমান সম্পত্তি ভাগ করার আইন আছে। অর্থাৎ, যদি ২০ বছর সংসার করার পর কোনো স্বামী-স্ত্রীর বিবাহ বিচ্ছেদ হয় তাহলে এ ২০ বছরে সৃষ্ট মোট সম্পত্তি সমান সমান ভাগ হবে। কিন্তু আমাদের দেশের বাস্তবতা হলো সংসার গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নারীর শারীরিক-মানসিক শ্রম থাকা সত্ত্বেও নারীরা স্বামীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের পর সম্পত্তির প্রায় কোনো অংশই পান না। ফলে গৃহিণীরা অসহায় হয়ে পড়েন। অনেক সময় আর্থিক নিশ্চিয়তা নেই বলে অনেকে অত্যাচারিত হয়েও স্বামীর সঙ্গে থাকতে বাধ্য হন। অথচ বিয়ের পর ওই সংসারের যা কিছু সম্পদ-সম্পত্তি অর্জিত হয়েছে গৃহিণী নারীরও সেখানে পরিপূরক ভূমিকা আছে। গৃহস্থালি কাজের আর্থিক মূল্য নিরূপণ ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি থাকলে পরিবারের ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন হতো। পারিবারিক নির্যাতনও কমতো।
বক্তারা আরও বলেন, বাজেট শুধু অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নয়, বাজেটের মাধ্যমে সরকারের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও প্রতিফলিত হয়। দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারীর অগ্রযাত্রার সঙ্গে দেশের এগিয়ে যাওয়াও যুক্ত। অথচ আমাদের দেশে প্রতি বছর যে জেন্ডার বাজেট হয় তা জাতীয় বাজেটের মাত্র ১ শতাংশের মতো যা মূলত বিভিন্ন ভাতা প্রদানেই সীমাবদ্ধ। ভাতাগুলোর পরিমাণও খুব সামান্য। যে কারণে নারীরা কর্মক্ষেত্রে আসতে পারেন না বা কর্মক্ষেত্র থেকে ঝরে পড়েন। এসব বাধাগুলো দূর করার কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার জন্য বাজেটে বরাদ্দ থাকে না। সরকারি উদ্যোগে উপজেলায় উপজেলায় ডে-কেয়ার সেন্টার ও কর্মজীবী নারী হোস্টেল নির্মাণের জন্য বাজেট বরাদ্দ করলে অনেক নারী কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হতে পারে। কিন্তু সে বিষয়ে বাজেটে বরাদ্দ থাকে না। স্বাস্থ্যসম্মত পাবলিক টয়লেট নির্মাণ, হাসপাতালে মাতৃসদন নির্মাণে খুব বেশি বাজেট বরাদ্দ লাগে না। কিন্তু এগুলো বিবেচনায়ই আসে না সরকারের।
তারা বলেন, নারীর সম অধিকার নিশ্চিত করা এবং পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে সমাজে ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা তা দূর করার কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের এবং সেসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে বাজেটে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ রাখতে হবে। পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে নারীর শ্রমের অবদানের স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে হবে।
সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের সভাপতি প্রকৌশলী শম্পা বসুর সভাপতিত্বে ও ঢাকা নগর শাখার সাধারণ সম্পাদক রুখশানা আফরোজ আশার সঞ্চালণায় সমাবেশে আরও উপস্থিত ছিলেন ফোরামের ঢাকা নগর শাখার সভাপতি সেলিনা ইয়াসমিন কনা, সাংগঠনিক সম্পাদক শরীফা বেগম, শ্রম বিষয়ক সম্পাদক খাদিজা রহমান, সাংস্কৃতিক সম্পাদক সুস্মিতা মরিয়ম ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মুক্তা বাড়ৈ।
সমাবেশ শেষে তারা অর্থমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি পেশ করতে যান।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪০ ঘণ্টা, মে ২৯, ২০২৩
এসসি/জেএইচ