ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

মাস্টার-ড্রাইভারশিপ পরীক্ষায় স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন

তানভীর আহমেদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০১ ঘণ্টা, জুন ১০, ২০২৩
মাস্টার-ড্রাইভারশিপ পরীক্ষায় স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন

ঢাকা: যোগ্যতা নির্ধারণের ভিত্তিতে অভ্যন্তরীণ নৌ-যানের দক্ষ চালক তৈরির লক্ষ্যে বছরজুড়ে মাস্টার ও ড্রাইভারশিপ পরীক্ষার পদ্ধতি নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে নানা প্রশ্ন রয়েছে। প্রশ্নপত্র প্রস্তুতকারী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে লিখিত-মৌখিক পরীক্ষা নেওয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি রয়েছে।

অভিযোগ আছে, চিহ্নিত কিছু দালালের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে বিশেষ স্বার্থের বিনিময় পছন্দের প্রার্থীদের পাশ করিয়ে থাকেন একাধিক পরীক্ষক। এছাড়া মৌখিক পরীক্ষাকে গুরুত্বহীন করে সর্বশেষ জারি করা এক সার্কুলারে পুরো প্রক্রিয়াটিই পড়েছে প্রশ্নের মুখে। দীর্ঘ অনুসন্ধানে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

জানা গেছে, বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন নৌ-নিরাপত্তার স্বার্থে বিশেষজ্ঞসহ নৌ-যোগাযোগখাত সংশ্লিষ্টরা। তারা অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধে পরীক্ষা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিও তোলেন। কিন্তু জন গুরুত্বপূর্ণ এ দাবি আমলে নেয়নি পরীক্ষা গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ নৌ-পরিবহন অধিদপ্তর। এমনকি জাতীয় পর্যায়ের অনেক গণমাধ্যমে এ বিষয়ে বারবার প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও বিষয়টির ওপর নৌ-মন্ত্রণালয়ও নজর দেয়নি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, আলাদা দুটি পরীক্ষা বোর্ডের মাধ্যমে লঞ্চ ও তেলবাহী জাহাজসহ সব ধরনের অভ্যন্তরীণ নৌযানের মাস্টারও ড্রাইভারশিপ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। নৌ-অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ বোর্ড গঠন করেন। অধিদপ্তরের চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার (চলতি দায়িত্বে) ক্যাপ্টেন মো. গিয়াস উদ্দিন আহমদ মাস্টারশিপ পরীক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান; ড্রাইভারশিপ পরীক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান হন অধিদপ্তরের অস্থায়ী প্রধান প্রকৌশলী মনজুরুল কবির। প্রশ্নপত্র তৈরিসহ লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণ, লিখিত পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়ন এবং উত্তীর্ণ প্রার্থীদের সনদ প্রদান- সব কাজই অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা করেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, উভয় ক্ষেত্রে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় এবং সারা বছর শ্রেণিভেদে পৃথক পৃথক দিনে নেওয়া হয় এসব পরীক্ষা। রাজধানী ঢাকার মতিঝিলে অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের কাছে টয়েনবি সার্কুলার রোডের গাউছেপাক ভবনের পঞ্চম তলায় ভাড়া করা ফ্ল্যাটে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।

সূত্র জানায়, মাস্টার ও ড্রাইভারশিপ দুই ক্ষেত্রেই মাত্র ২০ নম্বরের লিখিত ও ১০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। লিখিত পরীক্ষায় ২০টি নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন থাকে। উত্তরদানের পদ্ধতি- প্রশ্নপত্রে টিক চিহ্ন। কোনো প্রার্থী দশটির সঠিক উত্তর দিতে পারলে তিনি উত্তীর্ণ হয়ে মৌখিক পরীক্ষার জন্য মনোনীত হবেন। সেখানে পাশ নম্বর সর্বনিম্ন ৫। এভাবে দুটি মিলিয়ে সর্বনিম্ন (১০+৫) বা ১৫ নম্বর পেলে প্রার্থী চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হয়ে সনদ পাবেন। এ সনদ যেকোনো ধরনের অভ্যন্তরীণ নৌ-যানে চাকরির ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক।

এদিকে পরীক্ষা পদ্ধতির স্বচ্ছতা নিয়ে বিতর্কের মধ্যেই নৌ-অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের এক সার্কুলারে মৌখিক পরীক্ষাকে গুরুত্বহীন করে ফেলা হয়েছে। গত ১০ ফেব্রুয়ারি জারি করা সার্কুলারে বলা হয়, লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সব প্রার্থী মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবেন। লিখিত পরীক্ষার সঙ্গে মৌখিক পরীক্ষার নম্বর সংযোজন করে সর্বমোট ৩০ নম্বরের মধ্যে ১৫ বা তদুর্ধ্ব নম্বরপ্রাপ্তরা উত্তীর্ণ মর্মে ফলাফল প্রকাশ করা হবে।

সূত্র মতে, এ সার্কুলারের ফলে একজন প্রার্থী ২০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষায় ১৫ বা তদুর্ধ্ব নম্বর পান এবং ১০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষায় পাঁচ (পাশ নম্বর) বা এর চেয়ে কম নম্বর এমনকি শূন্য নম্বর পান তাহলেও চূড়ান্ত ফলাফলে তিনি উত্তীর্ণ হবেন। অর্থাৎ মাস্টারও ড্রাইভারশিপ উভয় ক্ষেত্রেই মৌখিক পরীক্ষা একেবারেই গুরুত্বহীন হয়ে গেছে। বিতর্কিত সার্কুলার বহাল থাকলে যেসব কর্মকর্তা (পরীক্ষক) পছন্দের দালালদের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন। তারাই অনৈতিক লাভবান হন এবং দালালদের সঙ্গে আগাম চুক্তিবদ্ধ প্রার্থীরাই লিখিত পরীক্ষায় সর্বনিম্ন ১৫ নম্বর পেয়ে চূড়ান্তভাবে যোগ্য বিবেচিত হন।

এছাড়া প্রশ্নপত্র প্রস্তুতকারী কর্মকর্তাদের দিয়ে লিখিত পরীক্ষা নেওয়া ও উত্তরপত্র মূল্যায়ন এবং পরবর্তীতে উত্তীর্ণদের মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণের সুযোগে মাস্টার ও ড্রাইভারশিপ পরীক্ষা বোর্ডে যেসব অসাধু সদস্য রয়েছেন তাদের পক্ষে প্রশ্নপত্র ফাঁস করা খুবই সহজ হয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে পরীক্ষা বোর্ডের দুই চেয়ারম্যানই অনৈতিকভাবে অধিক লাভবান হচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।

নৌযান শ্রমিক ও কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. সবুজ সিকদার অভিযোগ করেন, যেকোনো শ্রেণির মাস্টার বা ড্রাইভারশিপ পরীক্ষায় পাশ করতে হলে দালাল মারফত আগাম টাকা দিতে হয়। কারণ, দালালদের মাধ্যমেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। তাই দালালের শরণাপন্ন না হলে অধিকাংশ প্রার্থীই ফেল করেন। প্রতিটি পরীক্ষায় এমন ঘটনা ঘটে বলে শ্রমিকরা অভিযোগ করে থাকেন। কিন্তু দীর্ঘদিনেও বিষয়টির সুরাহা হচ্ছে না।  

জানতে চাইলে নিরাপদ নৌ-পথ বাস্তবায়ন আন্দোলনের সদস্য সচিব আমিনুর রসুল বাবুল বলেন, অভ্যন্তরীণ নৌ-যানের মাস্টারশিপ ও ডাইভারশিপ পরীক্ষা পদ্ধতি সংস্কার করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য আমরা দীর্ঘদিন দাবি জানিয়ে আসছি। একই প্রতিষ্ঠান প্রশ্নপত্র তৈরি, লিখিত পরীক্ষা গ্রহণ ও উত্তরপত্র মূল্যায়ন, মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণ এবং সনদ প্রদান করবে- এটা গ্রহণযোগ্য নয়। নৌ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও বাংলাদেশ মেরিন একাডেমির বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গ্রহণযোগ্য পরীক্ষা বোর্ড গঠনের পক্ষে জোরালো মত দেন তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ১৫০০ ঘণ্টা, জুন ১০, ২০২৩
টিএ/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।