মাদারীপুর: ভিডিও কলে একমাত্র সন্তানকে অনেকবার চুমো খেয়েছেন বাবা মনির আকন। ছোট্ট রায়হানের সেই চুমোর আদর উপলব্ধি করার বয়স হয়নি এখনো।
গত শুক্রবার (৯ জুন) সৌদি আরবের রাস্তায় মরে পরে ছিলেন মাদারীপুরের মো. মনির আকন (৪৫)।
রোববার (১১ জুন) মনিরের মৃত্যুর খবর দেশে পৌঁছালে পরিবারে শোকের মাতম শুরু হয়। সন্তান হারিয়ে বৃদ্ধ মায়ের আহাজারি আর সামনে থেকে বাবাকে না দেখা সন্তানকে বুকে জড়িয়ে স্ত্রীর আর্তনাদে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে।
জানা গেছে, মাদারীপুর শহরের ৪ নম্বর শকুনি এলাকার মৃত সেকেন আকনের বড় ছেলে মনির আকন ধার-দেনা করে ২০১৭ সালের জুন মাসে সৌদি আরব যান। এরপর তেমন কোনো কাজ না পাওয়ায় উল্টো বাংলাদেশ থেকে তার পরিবার প্রায়ই তার খরচের জন্য টাকা পাঠাতেন। আকামা করার জন্য দেশ থেকে ধার-দেনা করে টাকা পাঠালেও ওই দেশের মালিক তা করে দেননি। আজ-কাল করেও আকামা না দেওয়ায় কোনো কাজই করতে পারছিলেন না মনির। তাই তিনি দেশেও আসতে পারছিলেন না। এমনকি ছেলে রায়হানের বয়স সাড়ে পাঁচ বছর হলেও মুখোমুখি দেখা হয়নি বাবা-ছেলের।
নিহতের পারিবারিক সূত্র জানায়, গত শুক্রবার (৯ জুন) সন্ধ্যায় মনির আকন তার ছোট বোন রোমানার সঙ্গে শেষ কথা বলেন। তখন মনির জানান, তার বুকে অনেক ব্যথা হচ্ছে। তিনি ওষুধ কিনতে ফার্মেসিতে যাচ্ছেন। এরপর আর কথা হয়নি। পরে সৌদি আরবের রিয়াদ শহরের সেফা নামক স্থানে রাস্তার ওপর তার মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেন ওই দেশের স্থানীয় লোকজন। তারা সে দেশের পুলিশকে খবর দেন। পুলিশ এসে মরদেহ উদ্ধার করেন। রাস্তায় পড়ে থাকা ছবি শুক্রবার রাত থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হয়। পরে নিহত মনিরের মরদেহের ছবি দেখে পরিবারের লোকজন সৌদি আরবে খোঁজ নেন। সেখানে নিহতের এক খালাতো ভাইয়ের কাছ থেকে মনির আকনের মৃত্যুর ব্যাপারটি নিশ্চিত হন তার পরিবার। এরপর থেকেই বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। নিহতের পরিবারের একটাই দাবি সরকারিভাবে মরদেহটি যেন বাংলাদেশে আনার ব্যবস্থা করা হয়।
নিহতের স্ত্রী মিনি বলেন, 'বিয়ের চার মাস পর মনির সৌদি আরব চলে গেছেন। তখন রায়হান গর্ভে। দুই মাস। সেই ছেলে জন্ম হলো। দেখতে দেখতে সাড়ে ৫ বছরের বেশি হয়ে গেলো। অথচ আমাদের এমন ভাগ্য যে, বাবা-ছেলের মুখোমুখি দেখাও হলো না। এর চেয়ে কষ্ট আর কি হতে পারে। তাই আমার ছেলের মুখের দিকে চেয়ে হলেও মনিরের লাশটা যদি দেশে আনা যেত। '
নিহতের বৃদ্ধা মা জাহানারা বেগম বলেন, ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে মনিরের বাবা মারা গেলেন। এরপর ২০২১ সালে কারেন্টের কাজ করতে গিয়ে আমার মেঝ ছেলে ওহিদুজ্জামান আকনও মারা গেল। এখন আমার বড় ছেলেও মারা গেল। অথচ আমি বেঁচে রইলাম। এত শোক আমি সইবো কেমনে!'
তিনি আরও বলেন, ছেলেটা অনেক দেনা করে সৌদি আরব গিয়েছিল। এমনকি সেখানে থেকে আমাদের কোনো টাকা পাঠাতে পারেনি। উল্টো আমরাই তার জন্য টাকা পাঠিয়েছি। আকামা করার জন্যও ধার করে টাকা পাঠিয়েছিলাম। সেই আকামাও করে দেয়নি মালিক। ওর হার্টে সমস্যা ছিল। শ্বাসকষ্টও ছিল। হয়তো ওষুধ কিনতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে রাস্তায় বসেই মারা গেছে। এখন আমাদের একটাই দাবি ওর লাশটি যেন সরকার দেশে এনে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়।
নিহতের বোন রোমানা আক্তার বলেন, 'ভাইয়ের সঙ্গে আমার শুক্রবার সন্ধ্যায় শেষ কথা হয়। তিনি বলেছিলেন তার বুকে অনেক ব্যথা করছে। ওই দেশে থাকেন বাংলাদেশের পরিচিত একজনের কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা ধার নিয়ে ওষুধ কিনতে যাচ্ছেন। সেই টাকাও বাংলাদেশের একজনকে আমাকে দিতে বলেছেন। অনেক দেনা আছে আমাদের। এই বাড়ি ছাড়া আমাদের কোনো জমি নেই, যে জমি বিক্রি করে ভাইয়ের লাশ আনবো। সৌদি আরবে যারা আছেন, তারা জানিয়েছেন লাশ দেশে আনতে ৫ লাখ টাকা লাগবে।
মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাইনউদ্দিন বলেন, কেউ যদি বৈধভাবে বিদেশ যায়, তাহলে অ্যাম্বেসি থেকেই লাশ পাঠানোর ব্যবস্থা করে থাকে। আর যদি অবৈধভাবে যায়, তাহলে অ্যাম্বেসি থেকে এ দেশের অ্যাম্বেসিতে যোগাযোগ করে থাকে। এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো খবর পাইনি বা কেউ আমাদের এখনও এ খবর জানায়নি। পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ সময়: ২০৩৫ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০২৩
আরএ