ঢাকা: নৌ যোগাযোগের পরিধি বাড়াতে নদী খনন ও পলি অপসারণ করে বিলুপ্ত নৌপথ পুনরুদ্ধারের যে পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল সরকার, দীর্ঘ একযুগেও তা পূরণ হয়নি। ক্ষমতাসীনদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির আলোকে নেওয়া অগ্রাধিকারভিত্তিক মেগাপ্রকল্পগুলো বাস্তবায়নেও প্রত্যাশিত সাফল্য দেখাতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
অভ্যন্তরীণ নৌপথের ৫৩টি রুটে ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের আওতায় প্রথম পর্যায়ে ২৪টি নৌপথের দুই হাজার ৪৭০ কিলোমিটার সব ধরনের নৌযান চলাচলের উপযোগী করার কথা ছিল। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় এক হাজার ৮৭৩ কোটি ৬৪ লাখ টাকা এবং এটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআইডব্লিউটিএ)।
পণ্য ও যাত্রীবাহী নৌযানসমূহের নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ চলাচলের জন্য ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ নৌপথসমূহের ক্রমহ্রাসমান নাব্য উন্নয়ন করা-ই ছিল প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য। প্রকল্পটি ২০১২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় এবং একই বছরের ২ ডিসেম্বর প্রশাসনিক অনুমোদন পায়। প্রকল্প বাস্তবায়নের সর্বশেষ সময়সীমা ছিল ২০১৮ সালের জুন মাস।
ধারাবাহিক তিন মেয়াদের সরকারের প্রথম মেয়াদে নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্প বাস্তবায়নের চিত্র হতাশাজনক। লক্ষ্যমাত্রা পূরণ তো দূরের কথা, এর ধারেকাছেও যেতে পারেনি বিআইডব্লিউটিএ। ২০১৭ সালের ১১ জানুয়ারি সংস্থাটির ড্রেজিং বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ছাইদুর রহমানের সই করা এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, উন্নয়ন ও সংরক্ষণ খাতের আওতায় গত ছয় বছরে মাত্র ৮০০ কিলোমিটার নৌপথের নাব্য উন্নয়ন করা হয়েছে।
তবে পরিসংখ্যানে উন্নয়ন ও সংরক্ষণ খাতের অগ্রগতি পৃথকভাবে উল্লেখ করা হয়নি। অথচ ২৪ নৌপথের দুই হাজার ৪৭০ কিলোমিটার নাব্য উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা ছিল শুধুমাত্র উন্নয়ন খাতের (ক্যাপিটাল ড্রেজিং) আওতায়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিং উইংয়ের পরিচালককে ২০১৭ সালের ২৩ জানুয়ারি লেখা এক চিঠিতে বিআইডব্লিউটিএর নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা (নৌনিট্রা) বিভাগের উপ-পরিচালক (জরিপ ও উন্নয়ন) মো. এনামুল হক ভূঁইয়া জানান, ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বর্ষা মৌসুমে ছয় হাজার কিলোমিটার ও শুকনো মৌসুমে চার হাজার ৩৪৭ কিলোমিটার নৌপথে নৌযান চলাচল করেছে।
একই বছরের ২১ মার্চ বিআইডব্লিউটিএর আইসিটি বিভাগের পরিচালককে লেখা আরেক চিঠিতে এনামুল হক ভূঁইয়া জানান, সরকারের বিশেষ গুরুত্ব ও কর্তৃপক্ষের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে নৌপথের দৈর্ঘ্য ৫৪৭ কিলোমিটার বেড়েছে। ড্রেজিং বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সাল পর্যন্ত নতুন ৬০০ কিলোমিটার নৌপথ সচল হয়েছে। একই সংস্থার দুই বিভাগের দুরকম তথ্যে (এক বছর সময়ের ব্যবধানে) নৌপথ পুনরুদ্ধারে বিআইডব্লিউটিএর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
নৌপথ পুনরুদ্ধারে বিআইডব্লিউটিএর ব্যর্থতা শুধু প্রথম মেগাপ্রকল্পেই শেষ নয়। বাস্তবায়নের মেয়াদ অর্থাৎ ছয় বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও সংস্থাটি নানা অজুহাতে প্রকল্পের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সংস্থার ড্রেজিং বিভাগের কর্মকর্তাদের দাবি, সময় বাড়লেও ড্রেজিং যথাযথভাবে হয়েছে, সেখানে কোনো অনিয়ম হয়নি।
ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে প্রথম পর্যায়ে ২৪ নৌপথ সচলকরণ প্রকল্পের আওতায় বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ ছিল। সেগুলোর কয়েকটি হলো- ঢাকা-মুন্সীগঞ্জ-গজারিয়া-চাঁদপুর-চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-সেন্ট মার্টিন দ্বীপ-টেকনাফ, চাঁদপুর-চরপ্রকাশ-হিজলা-বরিশাল, ঘসিয়াখালী-বরিশাল-কালীগঞ্জ-চাঁদপুর-আরিচা, ভৈরব বাজার-লিপসা-ছাতক-সিলেট, নরসিংদী-কটিয়াদী, নরসিংদী-মারিচাকান্দি-সলিমগঞ্জ-বাঞ্ছারামপুর-হোমনা, দাউদকান্দি-হোমনা-রামকৃষ্ণপুর, চাঁদপুর-ইচুলী-ফরিদগঞ্জ, বরিশাল-ঝালকাঠি-বরগুনা-পাথরঘাটা, খুলনা-গাজীরহাট-বরদিয়া-মানিকদা, পঞ্চগড়-দিনাজপুর-নওগাঁ-নাটোর-পাবনা, দিলালপুর-ঘোড়াদিঘা-চামড়াঘাট-নিকলি-আটপাড়া-নেত্রকোনা, মনুমুখ-মৌলভীবাজার, মিরপুর-সাভার ও পটুয়াখালী-মির্জাগঞ্জ।
বিআইডব্লিউটিএ যথাযথভাবে ড্রেজিংয়ের দাবি করলেও এসব নৌপথের একটিতেও কাঙ্ক্ষিত নাব্য উন্নয়ন হয়নি। পরবর্তী সময়ে বেশিরভাগ নৌপথে সংরক্ষণ খাতের আওতায় পুনরায় ড্রেজিং করা হয়েছে এবং এখনো অনেক নৌপথ পুরোপুরি সচল হয়নি। অভ্যন্তরীণ নৌপথ ব্যবহারকারী নৌযানমালিকদের বিভিন্ন সংগঠন বলছে, বিআইডব্লিউটিএ যে পরিমাণ নৌপথ সচল করার দাবি করছে, তা শুধু কাগজে-কলমে হয়েছে।
লঞ্চমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল (যাত্রী পরিবহন) সংস্থার সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান বদিউজ্জামান বাদল জানান, কর্তৃপক্ষের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য ড্রেজিং কার্যক্রমের সঙ্গে একজন লঞ্চমালিক ও একজন অভিজ্ঞ সাংবাদিককে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেছিলেন তারা। কিন্তু বিআইডব্লিউটিএ তা আমলে নেয়নি।
‘নদী খনন ও ড্রেজিং কাগজে-কলমে হচ্ছে’ অভিযোগ করে এই লঞ্চমালিক নেতা বলেন, বাস্তবে নৌপথগুলো পুনরুদ্ধার হচ্ছে না। বরং তীব্র নাব্যসংকটের কারণে গত এক দশকে ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়ার অনেক রুটই পরিত্যক্ত কিংবা বন্ধ হয়ে গেছে। ড্রেজিংয়ে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসেনি।
পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, নদী খননের জন্য যেসব মেগাপ্রকল্প প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর কয়েকটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তবে খনন ও পলি অপসারণ পদ্ধতিতে অনেক ত্রুটি রয়েছে। এ ছাড়া অপ্রয়োজনীয় কিছু প্রকল্পও নেওয়া হয়েছে। এসব কারণে রাষ্ট্রের প্রচুর অর্থ ব্যয় হলেও জনগণের প্রত্যাশিত কল্যাণ হচ্ছে না।
তিনি বলেন, কোনো প্রকল্প চূড়ান্ত করার আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত নদী পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করা। এক্ষেত্রে তা করা হচ্ছে না। এ ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ঘাটতিও থেকে যাচ্ছে।
বিআইডব্লিউটিএর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (ড্রেজিং) সাইদুর রহমানের কাছে জানতে চাওয়া হয়, ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে ২৪ নৌপথের দুই হাজার ৪৭০ কিমি সচল করার যে প্রকল্প ২০১২ সালে নেওয়া হয়েছিল, সেই প্রকল্পের কত কিলোমিটার প্রকৃতপক্ষে সচল হয়েছে এবং প্রকল্পের সর্বশেষ পরিস্থিতি কী। জবাবে তিনি বলেন, প্রকল্পের কাজ ২০২১ সালে শেষ হয়েছে। ২০১৮ সালের প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা থাকলেও কত শতাংশ কাজ হয়েছে, তা তিনি জানেন না।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৭, ২০২৩
টিএ/আরএইচ