ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

ঘুষ বাণিজ্যে ৮ বছরে ‘বিত্তশালী’ ইউপি সদস্য, অভিযোগ এলাকাবাসীর

জাহিদুল ইসলাম মেহেদী, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০২৩
ঘুষ বাণিজ্যে ৮ বছরে ‘বিত্তশালী’ ইউপি সদস্য, অভিযোগ এলাকাবাসীর বেতাগীতে ইউপি সদস্যের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে নামেন এলাকাবাসী। ইনসেটে অভিযুক্ত ইউপি সদস্য আলতাফ হোসেন।

বরগুনা: একটা সময় জরাজীর্ণ একটি ঘরে কোনোমতে বসবাস করতেন বরগুনার বেতাগীর আলতাফ হোসেন। তিন বেলা খেয়ে বেঁচে থাকাটাই দায় ছিল তার।

তবে পর পর দুবার ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হওয়ার পর সেই আলতাফ এখন বিত্তশালী।  

উপজেলার হোসনাবাদ ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আলতাফ হোসেন। তিনি ওই ওয়ার্ডেরই আওয়ামী লীগের সভাপতি।

অনিয়ম দুর্নীতি ও ঘুষ বাণিজ্যের সিন্ডিকেট তৈরি করে আট বছরের ব্যবধানে এসব সম্পদ গড়েছেন আলতাফ, এমনটাই দাবি স্থানীয়দের।  

স্থানীয়দের কেউ কেউ হিসেব দিচ্ছেন, ইউপি সদস্য আলতাফের সম্পত্তির পরিমাণ এখন অর্ধকোটি ছাড়িয়ে।

আলতাফ হোসেনের বিরুদ্ধে ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ এনে সম্প্রতি বিক্ষোভ মিছিলও করেছেন স্থানীয়রা।

গত শুক্রবার ও শনিবার বিকালে ৭ নম্বর ওয়ার্ড সংলগ্ন খানেরহাট এলাকার বঙ্গবন্ধু সড়কে বিক্ষোভ মিছিল করেন স্থানীয় শতাধিক বাসিন্দা।

বিক্ষুব্ধ ভুক্তভোগীরা মিছিলে ক্ষিপ্ত হয়ে আলতাফের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন।  

তাদের অভিযোগ, টাকা ছাড়া কোনো কাজই করেন না ইউপি মেম্বার আলতাফ, ঘুষ বাণিজ্যের মহানায়ক তিনি। নিজ পদের ক্ষমতার দাপট ও দলীয় নেতাদের ছত্রছায়ায় অনিয়ম দুর্নীতি করেই গড়েছেন ঘুষ বাণিজ্যের সাম্রাজ্য। কিন্তু দেখার কেউ নেই।

যাদের কাছ থেকে বিভিন্ন সুবিধা দেওয়ার নাম করে উৎকোচ নিয়েছেন আলতাফ, তারা বিক্ষোভ মিছিলের পর সেই ঘুষের টাকার প্রমাণ ও পরিমাণ উল্লেখ করেন।  

তবে লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেবেন বলে এলাকাবাসীকে আশ্বাস দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন।  

সরেজমিনে খোঁজ নিলে জানা যায়, ছোপখালী গ্রামের বাসিন্দা মৃত কাছেম আলী হাওলাদারের ছেলে আলতাফ হোসেন। পরিবারের অভাব অনটনের কারণে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরুতে না পারলেও অদৃশ্য ক্ষমতার দাপটে পর পর দুইবার হয়েছেন ইউপি সদস্য।

এলাকাবাসী বলছেন, প্রথমবার তাদের ভোটে নিবার্চিত হলেও পরে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি আলতাফকে।
দ্বিতীয়বার ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীর ছত্রছায়ায় ইউপি সদস্য হন আলতাফ। পরে পদ পেয়ে হন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি। এরপরই ঘুষ বাণিজ্য, অনিয়ম ও দুর্নীতি বাড়তে থাকে তার।

বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নেওয়াদের অভিযোগ, এলাকায় কোনো সালিশের ব্যবস্থা হলেই পকেট ভারী হয় আলতাফ হোসেনের। বিভিন্ন ঝামেলা মিটিয়ে দেওয়ার নামে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও ইউপি চেয়ারম্যানকে ম্যানেজ করতে হবে বলে লোকদের কাছ থেকে বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেন তিনি।  

ইউপি সদস্য আলতাফের বিরুদ্ধে দলিল জালিয়াতির মামলাও চলছে বরগুনা আদালতে।

ওই মামলার বিষয় জানাজানি হলে আলতাফের অনিয়ম দুর্নীতি করে সম্পদের মালিক হওয়ার বিষয়টি আলোচনায় আসে।  

ভুক্তভোগী রীনার পরিবারের করা মামলার এজাহারের বলা হয়েছে, স্থানীয় মৃত জয়তুন বিবিকে জীবিত দেখিয়ে ভুয়া সিল স্বাক্ষর ব্যবহার করে ওয়ারিশ সনদ তৈরি করেন আলতাফ। পরে ৩০ লাখ টাকা মূল্যে ওই জমি বিক্রি করা হয় আলতাফের মাধ্যমেই। এবং ভুয়া ওয়ারিশদের নামমাত্র টাকা ধরিয়ে দিয়ে বাকি টাকা আত্মসাৎ করেন আলতাফ।  

এদিকে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ঘুষ দিয়ে মাসের পর মাস ঘুরে ইউপি সদস্য আলতাফের কাছ থেকে কোনো সুবিধাও পাচ্ছেন না। আবার তাকে দেওয়া ঘুষের টাকাও ফেরত পাচ্ছেন না তারা।  

স্থানীয় বাসিন্দা বাবুল ঘরামি দাবি করেন, একটি টিউবওয়েল স্থাপন করে দেবেন আশ্বাস দিয়ে তার কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছেন আলতাফ।  

দিনমজুর কুলসুম বেগমের অভিযোগ, কার ছেলের নামের মামলা উঠিয়ে আনার কথা বলে নগদ ৪০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন আলতাফ। পরে দোকানঘর লিখে দিতেও নাকি চাপ দেন তিনি।  

কমল নামে এক বাসিন্দার অভিযোগ, তার বাড়ির রাস্তা করে দেওয়ার কথা বলে ২০ হাজার টাকা নেন আলতাফ।  
স্থানীয়রা আরও অভিযোগ করেন, মাতৃত্বকালীন ভাতায় নাম দিয়ে দেবে বলে ডালিম বেগমের কাছ থেকে ৫ হাজার, ভিজিডি কার্ড তৈরির নামে জলিল ঘরামির কাছ থেকে ৫ হাজার ,সিদ্দিক ঘরামির কাছ থেকে ৫ হাজার, সালাম ঘরামির থেকে ৫ হাজার টাকা নেন এই ইউপি সদস্য। এছাড়া নতুন টিসিবি কাডপ্রতি জিতেন শিল ২ হাজার, কামাল সরদার ২৫০০,এবং বানেছা বেগমের কাছ থেকে ১৫০০ টাকা ঘুষ নেন ইউপি সদস্য আলতাফ।  

তারা সবাই মিলে একটি গণস্বাক্ষর দিয়ে ইউপি সদস্য আলতাফের নামে অভিযোগ তৈরি করেছেন, যা বেতাগী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও বরগুনা জেলা প্রশাসক বরাবর পাঠাবেন বলে জানান বিক্ষোভ মিছিলের নেতৃত্বে থাকা আওয়ামী লীগ নেতা বাবুল হাওলাদার।

এসব অভিযোগ ও সম্পত্তি গড়ার তথ্যকে অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেছেন ইউপি সদস্য ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আলতাফ হোসেন।

তিনি বলেন, আমি যাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছি তাদের অনেকের টাকাই ফেরত দিচ্ছি। আমি গরিব মানুষ, আমার অত সম্পদ নাই। তবে আগের থেকে একটু ভালো আছি। মূলত এলাকার কিছু ব্যক্তি ষড়যন্ত্র করে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার ছড়াচ্ছে।

হোসনাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বলেন,‘ইউপি সদস্য আলতাফ যদি জনগণের টাকা এভাবে লোপাট করে থাকেন তবে সেই টাকা ফেরত দেওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ইউপি কার্যালয়ে ঢুকতে পারবেন না - এতটুকু নিশ্চিত করলাম। ভুক্তভোগীদের লিখিত অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা গ্রহণ করব। ’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ফারুক আহমেদ বলেন, ‘ওই ইউপি সদস্যের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৪০২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০২৩
এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।