ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

প্রতি শুক্রবার ২ শতাধিক ছিন্নমূলকে খিচুড়ি খাওয়ান চা-বিক্রেতা ফারুক

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০২৩
প্রতি শুক্রবার ২ শতাধিক ছিন্নমূলকে খিচুড়ি খাওয়ান চা-বিক্রেতা ফারুক

রাজশাহী: প্রতি শুক্রবার ২ শতাধিক ছিন্নমূলের মুখে আহার তুলে দেন রাজশাহীর এক চা-বিক্রেতা। নাম তার ফারুক হোসেন।

সাপ্তাহিক ছুটির দিনটি এলেই ফারুকের ছোট্ট ভ্রাম্যমাণ টি-স্টলে ভিড় জমায় ছিন্নমূল ক্ষুধার্তরা। ছিন্নমূলদের ক্ষুধা মেটাতে এক থেকে দেড় মণ চালের খিচুড়ি রান্না করেন ফারুক। তারা বিনামূল্যে পেট ভরে খেয়ে যায় খিচুড়ি, কখনও সুস্বাদু বিরিয়ানি।  

ফারুকের এই খাবার রান্না ও খাওয়ানোর পুরো চিত্রটি দেখতে হলে যেতে হবে রাজশাহী মহানগরীর গোরহাঙ্গা গোরস্থানের পশ্চিমমুখী ফটকে।

জানা গেছে, প্রায় আট বছর ধরেই নিয়মিত এই মানবিক কাজটি করে আসছেন চা-বিক্রেতা ফারুক। তবে শুরুটা হয়েছিল মাত্র  দুই কেজি চালের সবজি খিচুড়ি দিয়ে। ওই সময় যতটা সামর্থ্য ছিল তার। এরপর ছিন্নমূলদের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আয়োজনের বাজেটও বাড়ান ফারুক। বর্তমানে দেড় মণ চালের খিচুড়ি রান্না করেন তিনি।

আর যেদিন অর্থের জোগান বাড়ে সেদিন সুস্বাদু বিরিয়ানি রান্না করেন অসহায়দের জন্য। নিজ হাতে রান্না করা সেই খাবার তুলে দেন ছিন্নমূল মানুষদের মুখে।

গেল শুক্রবার জুমার পর গোরস্থানের পশ্চিমমুখী ফটক দিয়ে ঢুকতেই দেখা গেলে একদল মানুষের হুড়োহুড়ি। তাদের মধ্যে কেউ রিকশাচালক, কেউ ভিক্ষুক, কেউ পথচারী কেউ বা মুসাফির। কারও সাথে কারও কথা নেই। দেখা নেই, সম্পর্ক নেই। শুক্রবার হলেই চলে আসেন এখানে।  

দেখা গেল, গোরহাঙ্গা গোরস্থানের ভেতরে এবং তার পাশের ফুটপাতজুড়ে সারিবদ্ধ হয়ে বসে পড়ছেন অসহায় মানুষেরা। ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’- কবি সুকান্তের কবিতার বাস্তবচিত্র ফুটে ওঠে সেখানে। জাতপাত, ধর্ম, পেশা সব পরিচয়কে পেছনে রেখে তাদের চেহারায় একই বেদনা দেখতে পাওয়া যায়। এখানে সবার একটাই পরিচয় তারা সবাই ক্ষুধার্ত।

জানা গেল, মাঝে করোনা সংক্রমণের কারণে কিছুদিন বন্ধ থাকলেও ফারুকের এই মহতী কার্যক্রম চলছে নিয়মিতই, প্রতি শুক্রবার।  

দেখা মেলে চা-বিক্রেতা ফারুক হোসেনের। একবেলার খাবার বিলি বণ্টন নিয়ে খুবই ব্যস্ততা তার মাঝে। ফারুককে সহায়তা করতে কবরস্থান ফটকে স্বেচ্ছাশ্রম দিতে এসেছেন কয়েকজন।  

এমন ব্যস্ততার মাঝেই কাজের ফাঁকে ফাঁকে কথা হয় ফারুক হোসেনের সঙ্গে।

এমন উদ্যোগের নেপথ্যে রয়েছে তার ছেলেবেলায় কাটানো অসহায় এক জীবনের গল্প।

তিনি জানান, কেউই ছিল না তার। একেবারেই নিঃস্ব ছিলেন। দিনের পর দিন পেটে ক্ষুধার জ্বালা নিয়ে কষ্ট করেছেন। তাই খুব ভালোভাবেই বোঝেন ও জানেন ক্ষুধার কষ্ট কেমন। এক পর্যায়ে কোনো পথ না পেয়ে সহায়সম্বলহীন ফারুক আল্লাহর ওপর ভরসা করে খালি হাত-পা নিয়ে নিজ জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছেড়ে কাজের খোঁজে চলে আসেন এই রাজশাহী শহরে।

এরপর জীবন ও জীবিকার তাগিদে নানান ধরনের কাজ করেন। শেষ পর্যন্ত ছোট্ট একটি ভ্রাম্যমাণ টি-স্টল খোলেন। সেই স্টল অনেকটাই স্থায়িত্ব পায় গোরহাঙ্গা কবরস্থানের ফটকে। সেখানে চা বিক্রি করতে গিয়ে কবরস্থানের ফুটপাতে অনেক নিরন্ন মানুষকে দিনের পর দিন কষ্ট করতে দেখেন। দু-মুঠো খাবারের আশায় সারাদিন বসে থাকতে দেখেন। এরপর মাথায় চিন্তা আসে কীভাবে কয়েকজন মানুষকে হলেও খাওয়ানো যায়। আর এই চিন্তা থেকেই এক শুক্রবারে ফারুক দুই কেজি চালের খিচুড়ি রান্না করে বেশ কয়েকজন ক্ষুধার্ত মানুষকে খাওয়ান। এরপর আর থেমে থাকেনি ফারুকের এই মানবসেবা।

ফারুক হোসেন এ সময় তার ছোটবেলায় খাবারের হোটেল থেকে চাকুরিচ্যুত হয়ে ক্ষুধার্ত থাকার সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। বলেন, আমার কিছুই বলার নেই। ক্ষুধার জ্বালা কি জিনিস তা আমি বেশ জানি। তাই সামর্থ্য না থাকলেও ছোট্ট করে হলেও মানুষের মুখে আহার তুলে দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি।  

তিনি জানান, নিজের ব্যবসা থেকে কিছু টাকা দেন। আর কিছু টাকা মানুষের দান বা সহযোগিতা থেকে আসে। যখন যেমন অর্থের জোগান হয় তখন তেমন রান্না করেন।

প্রতি শুক্রবার সাধারণত সবজি খিচুড়ি থাকে। এরপরও কোনো কোনো সপ্তাহে গরুর মাংস ও পোলাও রান্না করা হয়। প্রধান সড়কের পাশে এরকম অদম্য উদ্যোগ দেখে অনেকেই তার মৃত বাবা-মা, ভাই-বোন, সন্তান বা আত্মীয়-স্বজনের জন্য ফারুকের মাধ্যমে ক্ষুধার্ত মানুষকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেন।  

এভাবেই দিন, মাস ও বছর কেটে যাচ্ছে৷ যতদিন বেঁচে থাকবেন এই কাজটি করে যেতে চান ফারুক।

এক প্রশ্নের জবাবে চা-বিক্রেতা ফারুক হোসেন জানান, ক্ষুধার্ত মানুষের কষ্ট অনুধাবন করে তিনি তার জীবনের কষ্টগুলো শক্তিতে রূপ দিয়েছেন। বর্তমানে প্রতি শুক্রবার ২৫০ থেকে ৩০০ ছিন্নমূল মানুষের মুখে বিনামূল্য খাবার তুলে দেন তিনি।

 প্রায় পঁচিশ বছর ধরে চা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন ফারুক। নিঃস্বার্থভাবে ছিন্নমূল মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার কারণে অনেকের কাছে তিনি এরই মধ্যে হয়ে উঠেছেন প্রিয় মানুষ। কারও কারও কাছে- ‘ফারুক ভাই’।

এসব নিরন্ন মানুষের ভাষ্যমতে- দেশে ধনী মানুষের সংখ্যা অনেক। ফারুক ভাইয়ের কাছে হয়ত তাদের মতো কাড়ি কাড়ি টাকা নেই। কিন্তু আল্লাহ তাকে বড় মন দিয়েছেন। গরিবের মুখে আহার তুলে দেওয়ার তৌফিক দিয়েছেন। এমন কাজের জন্য নিশ্চই আল্লাহ তার মঙ্গল করবেন, তাকে ক্ষমা করে দেবেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৬১৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০২৩
এসএস/এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।