ঢাকা: যানজটে মন্থর নগরীর শীর্ষে ঢাকা। রাজধানী শহর ঢাকাকে গতিশীল করতে নেওয়া প্রকল্প এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালু হয়েছে এক মাস হলো।
উদ্বোধনের পর থেকে সোমবার (২ অক্টোবর) পর্যন্ত সরেজমিনে উঠে এসেছে, বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত চালু হওয়া অংশে এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহারকারীরা যানজট এড়িয়ে চলাচল করতে পারছেন। তবে তাতে কমেনি বনানী, মহাখালী, বিজয় সরণি, তেজগাঁও ও ফার্মগেট এলাকার যানজট। বরং এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠা ও নামার র্যাম্পের কারণে বেড়েছে বিজয় সরণি মোড়ের যানজট।
৯৯ শতাংশই ব্যক্তিগত যানবাহন
উদ্বোধনের আগে থেকেই নগর বিশেষজ্ঞরা বলছিলেন যে, এটি মূলত ব্যক্তিগত গাড়ির সুবিধার জন্য কাজ করবে। বাস্তবেও গত এক মাসে সেটাই ফুটে উঠেছে।
সেপ্টেম্বরের ২ তারিখে চালুর পর থেকে ০১ সেপ্টেম্বর সকাল ৬টা পর্যন্ত অর্থাৎ ২৮ দিনে মোট চলাচলকারী গাড়ির ৯৯ শতাংশ ব্যক্তিগত যানবাহন।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, গত ২৮ দিনে মোট গাড়ি চলাচল করেছে আট লাখ ৩৬ হাজার ৫৫৮টি। আর এ সময়ে মোট টোল আদায় হয়েছে ৬ কোটি ৭৭ লাখ ৪৩ হাজার টাকা।
এরমধ্যে প্রাইভেটকার, ট্যাক্সি, জিপ, স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিক্যাল, মাইক্রোবাস (১৬ সিটের কম) এবং হালকা ট্রাক (৩ টনের কম) ৮০ টাকা টোল, যেগুলোকে ক্যাটাগরি ১ বলা হয়ে থাকে সেসব গাড়ির সংখ্যা ৮ লাখ ২৮ হাজার ৯৮৭। যা মোট সংখ্যার ৯৯ ভাগেরও বেশি।
এরপর আছে ক্যাটাগরি ২ বা মাঝারি ট্রাক (৬ চাকা পর্যন্ত) ৩২০ টাকা টোল, যার সংখ্যা ১৩৮০টি। ক্যাটাগরি ৩ বা ট্রাক (৬ চাকার বেশি) ৪০০ টাকা টোল; এ গাড়ির সংখ্যা ৪৯টি। আর ক্যাটাগরি ৪ বা সব ধরনের বাস (১৬ সিট বা তার বেশি) ১৬০ টাকা টোল, এসব গাড়ির সংখ্যা ছয় হাজার ১৪২টি।
এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে গড়ে প্রতিদিন গাড়ি চলেছে ২৯ হাজার ৮৭৭টি। আর দৈনিক ২৪ লাখ ১৯ হাজার টাকার টোল আদায় হয়েছে।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক এ এইচ এম এস আকতার বলেন, এক্সপ্রেসওয়ে চালুর শুরুর দিকের চেয়ে গাড়ির সংখ্যা অনেক বেড়েছে।
এক্সপ্রেসওয়ের কতটুকু সুবিধা পাচ্ছেন বাসযাত্রীরা
এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করলে বেসরকারি গণপরিবহনগুলো যানজট এড়াতে পারতো। তবে এক্সপ্রেসওয়েতে উঠলে চলতি পথের যাত্রী সংকট হবে, এমন অজুহাতে চলাচল করছে না বেসরকারি গণপরিবহন। মহাখালী বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন র্যাম্পটি চালু না হওয়ায় এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করছে না কোনো কোনো পরিবহন। ফলে নগরীর অভ্যন্তরে কমছে না গাড়ির অতিরিক্ত চাপ।
তবে গত ১৮ সেপ্টেম্বর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশন (বিআরটিসি) বাস চালু করে।
বিআরটিসি সূত্র জানিয়েছে, শুরুর দিনে ৮টি বাস চলাচল করে সংস্থাটি আয় করে প্রায় ৬৮ হাজার টাকা। তবে দ্বিতীয় দিন দ্বিগুণ হয়ে আয় হয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার টাকা।
এরপর থেকে বিআরটিসি বাড়িয়েছে বাসের সংখ্যা আর আয়ও বেড়েছে। ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ১ অক্টোবর পর্যন্ত ১৪ দিনে বিআরটিসি ৭৪০টি ট্রিপে টিকিট বিক্রি করেছে ৬৯ হাজার। এ থেকে সংস্থাটির আয় প্রায় ২৫ লাখ টাকা।
এরমধ্যে একদিনে সর্বোচ্চ আয় হয়েছে ২৭ সেপ্টেম্বর। সেদিন ১১টি বাসে প্রায় ৭২টি ট্রিপ দিয়ে সংস্থাটির আয় হয় প্রায় ২ লাখ ৪২ হাজার টাকা।
উত্তরা থেকে কলাবাগানে অফিসগামী আশিকুর রহমান বলেন, আগে যেখানে দুই ঘণ্টা লাগতো, এখন সেখানে ৩০ থেকে ৪০ মিনিটে এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে যাতায়াত করতে পারি।
এছাড়া সকালে ও বিকেলে অফিসগামী যাত্রীদের জন্যে গাজীপুর থেকে আজিমপুরগামী ভিআইপি পরিবহনের কিছু বাস চলাচল করছে এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে।
ধানমন্ডি থেকে উত্তরা রুটে নিয়মিত চলাচলকারী শফিকুল ইসলাম বলেন, অফিস শেষে বাস স্টপেজে দাঁড়ালে কিছু বাস সরাসরি এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে যায়। এই বাসগুলোতে যাওয়ায় এক ঘণ্টা আগে বাসায় ফিরতে পারছি।
পূর্বাচল, গুলশাল ও প্রগতি সরণি রুটেও বাস চালু করতে বিআরটিসির কাছে দাবি জানিয়েছেন এসব রুটে চলাচলকারী বাস যাত্রীরা।
চালু হয়নি একাধিক র্যাম্প
সরেজমিনে দেখা যায়, এখনও মহাখালী, বনানীতে এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠার দুটি র্যাম্প চালু হয়নি। বনানীর সেতু ভবন থেকে মহাখালীর তেজগাঁও পর্যন্ত তীব্র যানজট ছিল। নগরীর মধ্যে ১৩টি র্যাম্প থাকলেও মোটরসাইকেল, সিএনজি চালিত অটোরিকশা এক্সপ্রেসওয়ের কোনো সুবিধা পাবে না।
কমেনি এক্সপ্রেসওয়ের নিচের সড়কের যানজট
নগরীর অধিকাংশ গণপরিবহন এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার না করায় মহাখালী, বনানী, ফার্মগেট অংশে প্রতিনিয়ত যানজটের চিত্র দেখা যাচ্ছে। একইসাথে মহাখালী বাসস্ট্যান্ডের আন্তঃজেলা পরিবহনগুলোও এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার না করে চলছে নিচের সড়ক দিয়ে। ফলে যানজটের চিত্র থেকে গেছে আগের মতোই।
এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, যে লক্ষ্য নিয়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে যাত্রা শুরু করেছে, সেটা পূরণ হয়নি। এটি চালু হলে বলা হয়েছিল ২০ থেকে ৩০ শতাংশ যানজট কমে যাবে, বাস্তবে তা হয়নি।
অধ্যাপক আদিল বলেন, এই এক্সপ্রেসওয়ে থেকে ফ্লাইওভার কাজ বেশি করছে। এক্সপ্রেসওয়েতে অল্পসংখ্যক মানুষ সুবিধা পাচ্ছে, যাদের ব্যক্তিগত গাড়ি আছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের তেমন কোনো উপকারে আসছে না। বলা হচ্ছে, এক্সপ্রেসওয়ে কিন্তু র্যাম্প আছে শহরের মধ্যেই। যেখানে শহরের এক প্রান্তের গাড়ি অন্য প্রান্তে যাবে, এটাই এক্সপ্রেসওয়ের শর্ত।
এক্সপ্রেসওয়ে লক্ষ্যমাত্রা দৈনিক ৮০ হাজারের বেশি যান
এক্সপ্রেসওয়ে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে দৈনিক সর্বোচ্চ ৮০ হাজার যানবাহন চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। আর সর্বনিম্ন যানবাহন চলাচল করতে পারে সাড়ে ১৩ হাজার।
৮০ হাজারের বেশি যানবাহন চলাচল করলে যে রাজস্ব আদায় হবে সেটির ২৫ শতাংশ বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ পাবে। আর সেতু কর্তৃপক্ষ থেকে ১০ শতাংশ দেবে রেলওয়েকে।
তবে দৈনিক সাড়ে ১৩ হাজারের চেয়ে কম যানবাহন চলাচল করলে বিনিয়োগকারীকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে সরকারের। তবে কাওলা থেকে কুতুবখালি পর্যন্ত পুরো এক্সপ্রেসওয়ে চালু না হওয়া এবং ৮০ হাজারের বেশি গাড়ি চলাচল না করাতে এখন যে টোল আদায় হচ্ছে, তা পুরোটা পাবে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।
এ প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক এ এইচ এম এস আকতার বলেন, পুরো এক্সপ্রেসওয়ে চালু হলে গাড়ি চলাচলের যে লক্ষ্যমাত্রা সেটি পূরণ হবে। তখন ৮০ হাজারের উপরে গাড়ি চললে রাজস্ব পাবে সরকার।
প্রসঙ্গত, ২০১১ সালের ১৯ জানুয়ারি এ প্রকল্পের প্রথম চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়। এই প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। প্রকল্পের বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে ২০১৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর সংশোধিত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের। প্রকল্পের মূল দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিমক ৭৬ কিলোমিটার। র্যাম্পসহ মোট দৈর্ঘ্য ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার।
তবে ভূমি অধিগ্রহণ, নকশা বদল, অর্থ সংস্থানের জটিলতায় ৪ বার সময় বৃদ্ধির ফলে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকায়।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ০২, ২০২৩
এনবি/এমজেএফ