ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

শ্যামনগরের ১০ যুবককে লিবিয়ায় জিম্মি, পিস্তল ঠেকিয়ে টাকা আদায় 

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ৪, ২০২৩
শ্যামনগরের ১০ যুবককে লিবিয়ায় জিম্মি, পিস্তল ঠেকিয়ে টাকা আদায়  লিবিয়ায় জিম্মি যুবকরা এবং গোল চিহ্নিত জন অভিযুক্ত মানব পাচারকারী হারুন

সাতক্ষীরা: ইতালি পাঠানোর প্রলোভনে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের ১০ যুবককে লিবিয়ায় নিয়ে জিম্মি করে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে একটি মানব পাচার চক্রের বিরুদ্ধে।  

স্থানীয় একটি মানব পাচার চক্রের খপ্পরে পড়া ওই যুবকদের মোবাইলে যোগাযোগের সুযোগ দিয়ে পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ বাবদ আদায় করা হচ্ছে টাকা।

টাকা দিতে দেরি হলে কিংবা অপারগতা প্রকাশ করলে জিম্মি যুবকদের মারধরসহ মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে সেই ভিডিও পাঠানো হচ্ছে পরিবারের কাছে।

এছাড়া একই চক্রের কবলে পড়ে ইতালি যাওয়ার পথে নৌ দুর্ঘটনার কারণে মাল্টা সাগর থেকে পুনরায় লিবিয়া ফিরে আসা ২০ যুবককে আটক করেছে স্থানীয় পুলিশ।

লিবিয়া তীরবর্তী এলাকায় নেমে পলায়নরত অবস্থায় পুলিশ শাহাজান হোসেন, সালামিন গাজী ও শেখ আসমতসহ ২০ জনকে আটক করে কারাগারে সোপর্দ করেছে।

নাম প্রকাশ হওয়া ওই তিন যুবক সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার নকিপুর গ্রামের আবু জাফর, মানিকখালী গ্রামের নুর আমিন ও কালিঞ্চি এলাকার জাকির আলীর ছেলে।

এছাড়া জিম্মি হওয়া ১০ যুবক হলেন- শ্যামনগর উপজেলার কৈখালী গ্রামের দেলোয়ার কয়াল, মামুন কয়াল, তারানীপুরের আবু রায়হান, বংশীপুরের মিলন, কৈখালীর আনারুল মিস্ত্রি, রহিম সরদার, মিঠু কয়াল, পূর্ব কৈখালীর জামির আলী জাম, আব্দুল কাদের ও রাসেল হোসেন।

ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা এসব তথ্য জানিয়েছেন।

স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, শ্যামনগর উপজেলার শ্রীফলকাঠি গ্রামের হারুন-অর রশিদ, তার ভগ্নিপতি মনিরুল ইসলাম এবং ধুমঘাট গ্রামের সেকেন্দার ও তাদের পরিচিত মুরাদ হোসেন মিলে সংঘবদ্ধ একটি মানব পাচারচক্র গড়ে তুলেছে।

স্থানীয়ভাবে সেকেন্দারসহ কয়েকজন নিকটাত্মীয়কে মানব পাচারের দায়িত্ব দিয়ে হারুন ঢাকা এবং মনিরুল ও মুরাদ লিবিয়ায় অবস্থান করে এই সিন্ডিকেট পরিচালনা করছে।

সূত্রমতে, শুরুতে আট থেকে নয় লাখ টাকায় সাগর পথে ইতালি পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসব যুবককে  লিবিয়ায় নিয়ে যায় তারা। পরে ভালো নৌযানে তুলে দেওয়াসহ নানা অজুহাতে আরও দুই থেকে তিন লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি অনেককে লিবিয়ায় সন্ত্রাসীদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে।  

ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর অভিযোগ, নির্বিঘ্নে ইতালি পৌঁছে দেওয়ার অঙ্গীকার করে হারুন ও সেকেন্দার তাদের কাছ থেকে আট থেকে ১০ লাখ টাকা আদায় করেছে। পরে তাদের লিবিয়ায় নিয়ে গেলেও দীর্ঘ সাত মাসেও ইতালিতে পৌঁছে দেয়নি তারা। বরং নানা বিপদ ও সমস্যার কথা বলে দুই থেকে তিন বারে আরও দেড় থেকে দুই লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

সালামিন হোসেনের বাবা আবু জাফর জানান, জমি বন্ধকের তিন লাখসহ মাজাট গ্রামের নুর মোহাম্মদ ও প্রভাষ কর্মকারের কাছ থেকে চড়া সুদে পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে তিনি সর্বসাকুল্যে ৮ লাখ টাকা দিয়েছেন। অথচ ইতালি ঢুকতে পারা তো দূরের কথা তার ছেলে গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে লিবিয়ার কারাগারে মানবেতর জীবনযাপন করছে।

অপর কারাবন্দী শাহাজানের বাবা নুর আমিন জানান, চাষের জমি বিক্রি করে হারুনের ‘টোপে’ পড়ে ছেলেকে ইতালি পাঠানোর চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কারাবন্দী হওয়ার পর থেকে তাকে ছাড়ানোর অজুহাতে হারুনের লোকজন বার বার এক লাখ দেড় লাখ টাকা দাবি করছে। শুধু সকালে ও সন্ধ্যায় খেতে দেওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, গত কিছুদিন ধরে হারুন আর মোবাইল রিসিভ করছে না।

এদিকে জিম্মি যুবকদের পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে, মানবপাচারকারী চক্রের প্রধান হারুন ও তার ভগ্নিপতি মনিরুলের সহায়তায় লিবিয়াতে মামুন, দেলোয়ার, আবু রায়হান, মিলন, আনারুল, আব্দুর রহিম, মিঠু ও জামির আলী জামুকে আটকে রাখা হয়েছে। তিন দফায় ১২ থেকে সাড়ে ১৩ লাখ পর্যন্ত টাকা পরিশোধের পরও অতিরিক্ত টাকা দাবি করে তাদের শারীরিক নির্যাতন করা হচ্ছে।

মামুন কয়ালের বাবা জাহার আলী কয়াল জানান, প্রায় এক মাস আগে আরও ৯ যুবকের সঙ্গে মিলে তার ছেলের একটি ভিডিও পরিবারের কাছে পাঠানো হয়। সামনে দাঁড়িয়ে ধারণকৃত সে ভিডিওতে বাড়ি থেকে ‘টাকা পাঠাও, টাকা পাঠাও’- এমন কাকুতি মিনতি করতে দেখা যায় মামুনসহ অন্যদের। জাহার আলী আরও জানান, ওই ভিডিও এলাকায় প্রচার হয়ে পড়লে পাচারচক্রের সদস্যরা বেকায়দায় পড়ে জিম্মি ওই যুবকদের দিয়ে নুতন একটি ভিডিও তৈরি করে পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেয়।

সেখানে চোখে-মুখে আতঙ্ক নিয়ে মামুনসহ অন্যদের বলতে দেখা যায় ‘সাংবাদিক ভাইয়েরা কোনো নিউজ করবেন না, আমরা ভালো আছি’। তবে মামুন ও তার এক সহযোগীর মাথায় রিভলবার ঠেকিয়ে গত সোমবার নুতন করে পাঠানো ভিডিওতে আবারও মামুনসহ অন্যদের টাকা চাইতে দেখা যায়।

জিম্মি দশায় থাকা সর্বকনিষ্ঠ রাসেলের বাবা আব্দুর রশিদ জানান, জিম্মি অবস্থা থেকে মুক্ত করার অজুহাতে গত বুধবার প্রত্যেকের পরিবারের কাছ থেকে হারুন ও তার লোকজন মাথাপিছু এক লাখ করে টাকা আদায় করেছে। হারুনের বোনসহ তার ভগ্নিপতি মনিরুলের ভাই সেকেন্দারের বিকাশে এসব টাকা দিতে হচ্ছে বলেও জানান তারা।

হারুন-মনিরুল-সেকেন্দার সিন্ডিকেটের হাতে অপর জিম্মি আব্দুল কাদেরের ভাই আব্দুর রাজ্জাক জানান, জমি বিক্রি করে আট লাখ টাকায় ভাইকে ইতালি পাঠিয়েছিলেন। তবে পাচারকারীরা তাদের লিবিয়ায় নিয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় রেখে দফায় দফায় আরও তিন/চার লাখ টাকা আদায় করেছে।  

তিনি অভিযোগ করেন, প্রায় এক মাস আগে একবার সাগর পাড়ি দেওয়ার চেষ্টায় ব্যর্থ হওয়ার পর থেকে প্রতিমাসে বাড়ি থেকে টাকা দিলে কেবল তার খাওয়া জুটছে। চরম অমানবিক অবস্থায় দিনাতিপাত করছে দাবি করে ভাইকে উদ্ধারে তিনি বৈদেশিক ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রীসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

এসব বিষয়ে মানবপাচার চক্রের হোতা হারুন-অর রশিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, কিছু মানুষকে গত মাসে নৌকায় তুলে দিলেও মাল্টা সাগর উত্তাল থাকায় তারা ফিরে আসে। এর মধ্যে কারাগারে থাকা তার তিনজনসহ ১৭ জনকে মুক্ত করার চেষ্টা চলছে।  

নিজেরা কাউকে জিম্মি করেনি দাবি করে পাচার চক্রের এই হোতা আরও জানান, তার ভগ্নিপতি মনিরুলের আস্তানা থেকে পালিয়ে যাওয়া কয়েকজন লিবিয়া সন্ত্রাসীদের হাতে আটক হওয়ায় তারা মুক্তিপণ চাইছে। সেখানকার সহযোগীদের সহায়তায় জিম্মিদশা থেকে সেসব যুবকদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছে বলেও তিনি দাবি করেন।  

এ বিষয়ে শ্যামনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবুল কালাম আজাদ জানান, ভুক্তভোগীদের কেউ এখনো থানায় অভিযোগ করেনি।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫০ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৪, ২০২৩
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।