ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

দশ বছরের শাহাদাতকে দেখতে লাগে ৮০ বছরের! 

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪১ ঘণ্টা, অক্টোবর ৮, ২০২৩
দশ বছরের শাহাদাতকে দেখতে লাগে ৮০ বছরের!  প্রোজিরিয়া রোগে আক্রান্ত ১০ বছরের শাহাদাত

মিরসরাই (চট্টগ্রাম) থেকে ফিরে: ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে এসে অপলক চাহনিতে তাকিয়ে থাকে শাহাদাত। একটার পর একটা গাড়ি আসে যায়।

বড় হয়ে একটি এসি বাস চালানোর স্বপ্ন তার কিন্তু ডাক্তার বলেছে সাকুল্যে সে ৩ থেকে ৫ বছর বেঁচে থাকতে পারে সে। তার বয়স ১০ বছর হলেও দেখে মনে হবে ৮০ বছর পেরিয়েছে।  

একমাত্র সন্তানদের এমন শারীরিক দশায় দিশেহারা বাবা-মা। চরম দুঃখ-কষ্টে কাটছে তাদের জীবন।  

চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মাইজগাঁও গ্রামের মো. হানিফ ও নাছিমা আক্তার দম্পতির ছোট সন্তান শাহাদাত। যে বয়সে শিশুদের সঙ্গে খেলায় ব্যস্ত থাকার কথা সে বয়সেই বৃদ্ধের তকমা লেগে গেছে তার গায়ে।  

বয়স ১০ হলেও তাকে দেখতে লাগে ৮০ বছরের বৃদ্ধের মতো। তাই অন্য শিশুরা তার সঙ্গে মিশতে চায় না, ভয় পায় তাকে। এদিকে ছেলেকে নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই বাবা-মায়ের।

মহাসড়কে চলাচলকারীরা প্রায় সময় শাহাদাতকে দেখে। ছেলেটির বয়স যে ১০ বছর কেউ ভাবতেও পারেনি।  

ফয়সাল নামের একজন জানান, আমরা ভাবতাম মানুষটির বয়স ৭০ থেকে ৮০ বছর। আজ যখন জানতে পেরেছি তার বয়স মাত্র ১০ বছর তখন খুব অবাক হয়েছি।  

শাহাদাতের বাবা-মা ও স্বজনরা জানায়,  জন্মের চার মাস পরই প্রোজিরিয়া নামক রোগে আক্রান্ত হয় সে। তখন তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে রেখে দেড় মাস চিকিৎসা করানো হয়। এতে কোনো প্রতিকার মেলেনি। চিকিৎসক বলেছেন এ রোগের ভালো চিকিৎসা বাংলাদেশে নেই। দুবছর পর তার শরীরে দেখা দেয় হার্নিয়া রোগ। এরপর অপারেশন করা হয়। তবে এখনো মাঝেমধ্যে ব্যথা করে।

মিরসরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. জেবায়ের আহমেদ বলেন, শিশুটির ছবি দেখে মনে হচ্ছে সে প্রোজিরিয়া রোগে আক্রান্ত। এটি খুবই বিরল একটি রোগ। এটি মূলত জেনেটিক কারণে হয় এবং এ রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বিরল। শিশু বয়সে গায়ের চামড়া কুঁচকে যাওয়া এ রোগের প্রধান লক্ষণ। শিশুটিকে দ্রুত ঢাকা পিজি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। সেখানে এটার চিকিৎসা রয়েছে। তবে এটির স্থায়ী সমাধান নেই। এছাড়া দেশের বাইরেও চিকিৎসা রয়েছে।  

শাহাদাতের মা নাছিমা আক্তার বলেন, দুটি মেয়ের পর আমার একটি ছেলে সন্তান হয়। অনেক খুশি হয়েছি। কিন্তু কিছুদিন পর আমার ছেলের শরীরের রোগ দেখা দেয়। যখন তার এই রোগ দেখা দিয়েছে, তখন তাকে নিয়ে চমেক হাসপাতালে দেড়মাস ছিলাম। সেখানে ডাক্তারের কোনো খরচ লাগেনি, তবে ওষুধ কিনতে হয়েছিল। জায়গা সম্পত্তি কোনো কিছু নেই যে বিক্রি করে ছেলের চিকিৎসা করাব।  

বাবা-মায়ের সঙ্গে শাহাদাত

তিনি আরও বলেন, ছেলেটা যদি সুস্থ হতো তাহলে অন্যান্য মানুষের সঙ্গে চলাফেরা করতে পারতো। ছেলের এমন জীবন মা হয়ে সহ্য করতে পারছি না। তিলে তিলে ছেলেটা আমার মৃত্যুর দিকে চলে যাচ্ছে।  

হতভাগ্য ছেলেটির বাবা হানিফ বলেন, রিকশা চালিয়ে কোনো রকম সংসার ও ছেলের চিকিৎসা খরচ চালাচ্ছি। মহাসড়কের পাশে সরকারি জায়গায় ছোট একটি ঘর বানিয়ে স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে নিয়ে কোনো রকমে দিন পার করছি। জানি না কতদিন থাকতে পারব এখানে। শুনেছি রাস্তা নাকি আরও বড় হবে, রাস্তা বড় হলে তো আমাদের এখানে থাকা সম্ভব না। এমনকি শাহাদাতকে ভালো খাবার বা খেলনা কোনো কিছুই কিনে দিতে পারি না। তখন অনেক খারাপ লাগে। ছেলেকে নিয়ে বাইরে বের হলে অনেকেই নানা ধরনের  মন্তব্য করে, তবুও কিছু বলতে পারি না।  

হানিফ তার ছেলের চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রামের জন প্রতিনিধি ও বিত্তবানদের সহযোগিতা চেয়েছেন।  

এমন জীবন নিয়ে চরম দুঃখ-কষ্টে কাটছে শাহাদাতের জীবন। শাহাদাত বলে, স্কুলের শিক্ষকরা অনেক আদর করেন আমাকে। কিন্তু বন্ধুরা আমার সঙ্গে খারাপ কথা বলে। আমার সঙ্গে খেলতে চায় না। আমাকে দলে নেয় না। আমি সুস্থ হয়ে  বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা করতে চাই। পড়ালেখা করতে চাই। পড়ালেখা করে বড় হয়ে এসি বাস চালাব আমি।  
এদিকে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আইনুল করিম মঞ্জু বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে প্রতিবন্ধী ভাতাসহ সব রকমের সহায়তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওয়াহেদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল কবির ফিরোজ এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিয়েছেন।  

গ্রামবাসী ও স্থানীয়রা মনে করছেন এলাকার বিত্তবানরা এগিয়ে এলে অসহায় শিশুটির চিকিৎসা মিলবে। সে একটি সুন্দর জীবন পাবে।  

স্থানীয় সংবাদকর্মী আজিজ আজহার বলেন, স্থানীয় বিত্তবানরা এগিয়ে এলে শাহাদাত আরো সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারবে।  

স্থানীয় যুবক শাহরিয়ার উদ্দিন তাওশির বলেন, ছোটকাল থেকেই শাহাদাতকে দেখে আসছি। ছেলেটা হঠাৎ বৃদ্ধ হয়ে যায়। তার এই অবস্থা দেখে প্রথমে আমি তাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও করে থাকি। এরপর আরো অনেকের নজরে আসে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৪৩১ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৮, ২০২৩
এসএইচডি/এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।