কুষ্টিয়া: জমির পরিমাণ মাত্র ৬০ শতক। চারিদিকে নেটের ছাউনি, ওপরেও নেটের ছাউনি দিয়ে ঘেরা।
নিজ নামের সঙ্গেই মিল করেই কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের জঙ্গলী কৃষি ব্লকের কাঞ্চনপুর এলাকার কৃষক সবুজ আলী চাষ করেছেন সবুজ রঙের ক্যাপসিকাম জাত অরবিট। মাত্র দুই মাসেই বিক্রি করেছেন লাখ টাকা। আশা করছেন তিন মাসেই তার সাত লাখ টাকার ক্যাপসিকাম বিক্রি করবেন তিনি। উদ্ভট, পাগলামি, জমি নষ্ট, ফালতু জিনিস চাষ, ফল হবে, খরচ উঠবে না নানান কথা শুনতে হয়েছে সবুজকে গ্রামের অন্য চাষীদের কাছ থেকে। এখন তার সাফল্য দেখে অন্য চাষিদের কাছে রোল মডেল সবুজ। ইতিপূর্বে এ এলাকার মানুষ ক্যাপসিকাম চাষ সর্ম্পকে জানতো না। এখন প্রতিদিনই ভিড় করেন তার জমিতে ক্যাপসিকাম দেখতে এবং চাষ শিখতে।
জানা গেছে, খাবারে বাড়তি স্বাদ যোগ করতে ক্যাপসিকাম ব্যবহার করা হয়। বাজারে সবুজ, লাল, হলুদ এই তিন রঙের ক্যাপসিকাম পাওয়া যায়। প্রতি ১০০ গ্রাম ক্যাপসিকামে ৮৬০ মিলিগ্রাম প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট ও ভিটামিন সি থাকে। এছাড়া এতে ভিটামিন বি, ই, কে, থিয়ামিন, ফলিক অ্যাসিড, রাইবোফ্লাভিন ইত্যাদি পাওয়া যায়। সবুজ ক্যাপসিকাম একটু অল্প বয়সীদের জন্য উপকারী। এতে ক্যাপসাইসিনস নামক এক ধরনের উপাদান থাকে, যা ডিএনএর সঙ্গে যুক্ত হয়ে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদানের সংযুক্ত হওয়াতে বাধা দেয়। এটি ক্যান্সার প্রতিরোধে কাজ করে। এ ছাড়া ক্যাপসিকাম মাইগ্রেন, সাইনাস, সংক্রমণ, দাঁতে ব্যথা ইত্যাদি ব্যথা দূর করে।
ইন্টারনেটের মাধ্যমে শুরুতে ক্যাপসিকাম চাষের ভিডিও দেখেন কৃষক সবুজ। পরে তিনি যোগাযোগ করেন কুমারখালী উপজেলা কৃষি অফিসে। সেখান থেকে তিনি ক্যাপসিকাম চাষ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারেন। পরে কৃষি অফিসের সহযোগিতায় প্রথমবার চাষ শুরু করেন তিনি।
কৃষক সবুজ বাংলানিউজকে বলেন, মোবাইলে কৃষি বিষয়ে ভিডিও দেখতে দেখতে ক্যাপসিকামের একটি চলে ভিডিও আসে। সেটা দেখি এবং চাষ করার চিন্তা করি। কিন্তু এটা কীভাবে চাষ করে সেটা জানতাম না। তাই উপজেলা কৃষি অফিসে যাই। সেখানে তারা আমাকে ক্যাপসিকাম চাষ সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দেয়। কিছুদিন পরে সে যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্প থেকে কুমারখালী উপজেলা কৃষি অফিসে তিনদিনের নিরাপদ উপায়ে সবজি চাষের প্রশিক্ষণ নেই। সেখানে কীটনাশক ছাড়া ও পানি কম লাগবে কীভাবে সে সর্ম্পকে জানতে পারি। এবং ক্যাপসিকাম চাষ সম্পর্কে জানতে পারি। তার কিছুদিন পরে আমাকে ২০ শতাংশ জমিতে ক্যাপসিকাম করার জন্য প্রদর্শনী দেন। কিন্তু আমি তার সঙ্গে আরও ৪০ শতাংশ যোগ করে প্রথমবার ৬০ শতাংশ জমিতে এ ক্যাপসিকামের চাষ শুরু করি।
তিনি আরও বলেন, ভালোভাবে জমি চাষ করে আমি অক্টোবর মাসের দিকে ক্যাপসিকামের চারা লাগায়। ৬০ শতাংশ জমিতে আমি ছয় হাজার ৫০০ মতো চারা লাগিয়েছি। লাইন করে ফাঁকা করে আমি এ চারাগুলো লাগানো হয়। জমিতের যাতে পোকা মাকড় এবং তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে তাই নেট ব্যবহার করেছি। এতে পাখিরও কোনো উপদ্রব নেই। সেই সঙ্গে পানি সেচের অপচয় কমাতে আমি মালচিং ব্যবহার করেছি। এর কারণে আমার জমিতে আগাছা হয়নি এবং সার ও পানি সেচ কম লাগছে। চাষের খরচও অনেক কমে গেছে।
কৃষক সবুজ বলেন, প্রায় দুই বিঘা জমিতে আমি কোনো প্রকার কীটনাশক দেয়নি। পোকা দমনের জন্য কৃষি অফিসের দেওয়া আমি হলুদ ও সাদা আঠাযুক্ত ফাঁদ ব্যবহার করেছি।
সবুজ আরও বলেন, কৃষি অফিস থেকে আমাকে ২০ শতক জমির জন্য ক্যাপসিকামের চারা, মালচিং পেঁপার, বাঁশ-খুটি, নেট, সার দিয়েছিল। এছাড়া সব মিলিয়ে আমার মোট দুই লাখ পাঁচ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে। ইতিমধ্যে জানুয়ারি মাসের ১ তারিখ থেকে ক্যাপসিকাম তোলা শুরু করেছি। বেশ ভালো হয়েছে এবং ফলগুলোও বেশ বড় বড় হয়েছে। এর মধ্যে আমি এই জমি থেকে এক হাজার কেজি ক্যাপসিকাম তুলেছি। যা কুষ্টিয়া শহরে ১৮০-২৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছি। গড়ে ২০০ টাকা ধরে হলেও দুই লাখ টাকার মতো বিক্রি করেছি। এখনো যে পরিমাণ ফল আছে তাতে আরও দুই হাজার কেজি মতো তোলা যাবে। এছাড়া আরও ধরছে। আশা করছি ৫-৭ লাখ টাকার মতো বিক্রি করতে পারবো।
চাষ সম্পর্কে তিনি বলেন, ক্যাপসিকাম চাষ খুবই সহজ। আমরা যেমন মরিচ চাষ করি ঠিক তেমনি। তবে একটু খেয়াল রাখতে হবে যাতে রোগবালাই না লাগে। আর যেহেতু এটা সালাদ বা কাঁচা খাওয়া যায় এজন্য কীটনাশক মুক্ত চাষ করা যায়।
উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন বাংলানিউজকে জানান, আমরা কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে কৃষকদের আধুনিক চাষাবাদে উদ্বুদ্ধ করে এখানে জৈব উপায়ে চাষাবাদ করানোর চেষ্টা করছি। সবুজ নামের এই কৃষক নিরাপদ উপায়ে ক্যাপসিকাম চাষ করছেন। বর্তমানে তার ক্ষেতের অবস্থা খুবই ভালো এবং তিনি বেশ লাভবান হবেন।
কুমারখালী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দেবাশীষ কুমার দাস বাংলানিউজকে জানান, কৃষি পরামর্শের পাশাপাশি নিরাপদ উপায়ে উচ্চ মূল্যের সবজি চাষে আমরা কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও প্রদর্শনী দিয়ে আসছি। যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় নিরাপদ সবজি চাষে প্রশিক্ষণ নিয়ে কাঞ্চনপুর এলাকার কৃষক সবুজ ক্যাপসিকাম চাষ করে বেশ সাফল্য পেয়েছেন। বাজারে ভালো দামও পাচ্ছেন। তার দেখাদেখি এলাকার অনেক কৃষক এখন ক্যাপসিকাম চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।
কৃষি প্রকৌশলী ও যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের জুনিয়র পরামর্শক (ফার্ম ম্যানেজমেন্ট ও পানি ব্যবস্থাপনা) উম্মে উমারা বাংলানিউজকে জানান, মাটি থেকে পানি বাষ্প হয়ে বাতাসে উড়ে যায়। মালচিং পেঁপার ব্যবহারের মাধ্যমে সবজি ফসলে পানির অপচয় রোধ করা সম্ভব। যার কারণে সেচ খরচ অনেকটা কমে যায়। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে চাষাবাদ করলে কৃষকরা অনেক বেশি উপকৃত হবেন।
কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. হায়াত মাহমুদ বাংলানিউজকে জানান, ক্যাপসিকাম উচ্চমূল্যের একটি সবজি। কৃষকরা এটি চাষ করে বেশ ভালো লাভবান হচ্ছেন। বর্তমানে কুষ্টিয়ায় অনেক বেকার যুবকেরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে মাধ্যমে এই ক্যাপসিকাম চাষ করে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে। আগামীতে এ ক্যাপসিকামের আবাদ বাড়বে বলে আশা করেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১১৩৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০২৪
এসএম