জামালপুর: জীবনবাজি রেখে দেশকে স্বাধীন করেছেন জামালপুরের বকশিগঞ্জের কামালপুর ইউনিয়নের দিঘলাকোনা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা রুইন্দ্র মারাক এবেন্দ্র। এছাড়াও ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পরও প্রতিবাদ করেন তিনি।
জানা গেছে, ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০২১ সালের ১৪ জানুয়ারি মারা যান জেলার একমাত্র ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মুক্তিযোদ্ধা রুইন্দ্র মারাক এবেন্দ্র। ১৫ জানুয়ারি তাকে গার্ড অব অনার দেন স্থানীয় প্রশাসন। এরপর খ্রিস্টিয় রীতি অনুযায়ী সম্পন্ন হয় তার দাফন।
পরিবারের অভিভাবককে হারিয়ে খুব কষ্টে দিন যাপন করতে থাকে মুক্তিযোদ্ধা রুইন্দ্র মারাক এবেন্দ্রের স্ত্রী মিলন মারাক ও একমাত্র সন্তান জয় দাংগো। এর মধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা রুইন্দ্র মারাক মারা যাওয়ার দুই বছর পর ২০২৩ সালের মার্চ মাসে পার্শ্ববর্তী শেরপুর জেলার বাসিন্দা সুবেন্দ্র সাংমা নিজেকে রুইন্দ্র মারাকের সন্তান দাবি করে অভিযোগ করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে। এরপর দুঃখের দিন শুরু হয় জয় দাংগো ও তার পরিবারের। বন্ধ হয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধা ভাতা। এখন অর্ধাহারে অনাহারে চলছে মৃত মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সংসার।
কান্না জড়িত কণ্ঠে রুইন্দ্র মারাক এবেন্দ্রের ছেলে জয় দাংগো বলেন, বাবা মারা যাওয়ার পর আমরা অভিভাবক শূন্য হয়ে পড়ি। এরপর আবার ভাতা বন্ধ হয়ে গেছে। আমি মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে সবার কাছে গিয়েছি। সবার দরজায় কড়া নেড়েছি। কিন্তু কেউ আমাদের কথা শুনছে না। আমাদের অবস্থা এখন খুবই শোচনীয়।
জয় দাংগো আরও বলেন, যে অভিযোগের ভিত্তিতে আমাদের ভাতা বন্ধ করা হয়েছে। সেই অভিযোগটি মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। সমাজসেবা সেই প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। তবুও আমাদের ভাতা চালু হচ্ছে না। আমার কোনো চাকরি নেই। এই ভাতার ওপর নির্ভর করে আমার সংসার চলতো। আমার বাবা জীবন বাজি রেখে দেশ স্বাধীন করেছে। এখন আমাদের সংসারই ধ্বংস হওয়ার পথে। এভাবে চলতে থাকলে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ানো ছাড়া আমাদের আর উপায় নেই। আমরা চাই ভাতা আবার চালু করা হোক।
মৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা রুইন্দ্র মারাকের স্ত্রী মিলন মারাক বলেন, যুদ্ধের পর থেকে আমরা ভাতা পাই। হঠাৎ করে একটা অভিযোগের কারণে আমাদের ভাতা বন্ধ হয়ে গেল। রুইন্দ্র মারাকের সন্তান দাবি করা সুবেন্দ্র সাংমার জাতীয় পরিচয় পত্রে তার বাবার নাম মহেন্দ্র মারাক। তার মা রিনিকা সাংমার জাতীয় পরিচয় পত্রে স্বামীর নাম মহেন্দ্র মারাক। এসব বিষয় তদন্ত না করেই আমাদের ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কর্তৃপক্ষ একবার চিন্তা করেনি আমাদের সংসার কীভাবে চলবে? এমনিই পাহাড়ে আয়ের উৎস নেই। আমরা এই ভাতার টাকায় চলি। সেটা বন্ধ। দিন দিন আমাদের দম বন্ধ হয়ে আসছে।
সুবেন্দ্র সাংমার অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত শুরু করে কর্তৃপক্ষ। ২০২৩ সালের ১৯ জুলাই বকশিগঞ্জ উপজেলা পরিষদে তদন্তের সময় সাক্ষ্য দেন উপজেলার সব মুক্তিযোদ্ধা। তারা সবাই জয় দাংগো তার পরিবারকে মৃত রুইন্দ্র মারাক এবেন্দ্রের পরিবার বলে সাক্ষ্য দেন।
বকশিগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলম বলেন, রুইন্দ্র আমার সঙ্গে ছিল। আমরা একসঙ্গে ট্রেনিং করেছি। আমি ওদের কোম্পানি টু আইসি ছিলাম। এর ভেতর কোনো সন্দেহ নেই। যারা এখন অভিযোগ দিয়েছে বা দাবি করছে তাহলে তাদের সঙ্গে আমাদের দেখা হলো না কেনো? তারা এতদিন কোথায় ছিল?।
কামালপুর ইউনিয়ন পরিষদের কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মজিবর বলেন, রুইন্দ্র মারাক এবেন্দ্রের সঙ্গে আমরা একসঙ্গে প্রশিক্ষণ নিয়েছি ও যুদ্ধ করেছি। আমরা জীবন বাজি রেখে এই দেশ স্বাধীন করেছি। ভাতার শুরু থেকে আমরা একসঙ্গে ভাতা উত্তোলন করেছি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মজিবর আরও বলেন, যে অভিযোগ করেছে বা দাবি করছে। তাদের আমরা মুক্তিযোদ্ধারা চিনি না। উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। এই বিষয় নিয়ে আমরা তদন্তের সময় সাক্ষ্য দিয়েছি। তবুও কোনো কাজে আসছে না। আমরা বেচে থাকতে যদি আমাদের সন্তানদের এই অবস্থা হয়। তাহলে আমরা মারা গেলে কী হবে। এই বিষয়টি খুবই দুঃখজনক।
তবে এসব বিষয়ে কোনো কথা বলতে নারাজ অভিযোগকারী সুবেন্দ্র সাংমা।
এসব বিষয়ে বকশিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অহনা জান্নাত বলেন, মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের ভাতা বন্ধ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে। এরপর আমাদের কাছে তদন্তের দায়িত্ব এলে আমরা তদন্ত করে তার প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। এখন এই বিষয়ে মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেবে। এখানে আমাদের করার কিছু নেই।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২১, ২০২৪
এসএম