ঢাকা: জলবায়ু পরিবর্তন অস্তিত্বের সংকট সৃষ্টি করে, বিশেষ করে পানিকে প্রভাবিত করে-মানবজাতি এবং বাস্তুতন্ত্রের জন্য যা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আমাদের চ্যালেঞ্জ হলো এ সমস্যা আমরা যে হারে তৈরি করছি, সে হারে তার সমধানের পথ বের করতে পারছি না।
বুধবার (২৪ জানুয়ারি) অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ আয়োজিত নবম আন্তর্জাতিক পানি সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়েরমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী এসব কথা বলেন।
মন্ত্রী আরও বলেন যে, পানি টেকসই উন্নয়নের অন্যতম উপাদান। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে আমাদের অবশ্যই বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এটি ব্যবহার করতে হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে, আমাদের প্রথম ১০০ দিনের পরিকল্পনায় জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় একটি বিস্তৃত কর্মসূচি রয়েছে। সামগ্রিক সমাধান খুঁজে বের করার জন্য সরকার, বিজ্ঞানী, এনজিও এবং বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করে একটি মাল্টি-স্টেকহোল্ডার প্ল্যাটফর্ম গঠন করা এখন সময়ের দাবি। অনেক প্রতিশ্রুতিশীল উদ্যোগ এবং স্টার্টআপ আবির্ভূত হয়েছে, কিন্তু প্রধান স্টেকহোল্ডারদের অংশিদারত্বের অভাবে প্রায়ই সেগুলো সফলতার মুখ দেখে না। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করে এমন প্রকল্পগুলো পাইলটিং করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা শুধু ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে নয়, সমাধান খোঁজার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে চাই। আশাকরি এ আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ফলাফল আমাদের নতুন দিক নির্দেশনা দেবে। জলবায়ু ন্যায়বিচারের জন্য আমরা যে সংস্থাগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি তাদের মধ্যে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ অন্যতম। এ প্রচেষ্টায় আমাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য আমি অন্যদেরও স্বাগত জানাই।
‘পানি, নদী এবং জলবায়ু পরিবর্তন: সহিষ্ণুতার ক্ষেত্র নির্মাণ’ এ প্রতিপাদ্য নিয়ে ঢাকার একটি হোটেলে দুই দিনব্যাপী নবম আন্তর্জাতিক পানি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
এ বছর ১০টি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এ পানি সম্মেলন- জলবায়ু পরিবর্তন এবং নদীর অধিকার-এর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক; জলবায়ু পরিবর্তন এবং নদী: ঝুঁকি ও বিপদাপন্নতা; উন্নয়ন, অন্তর্ভুক্তি এবং সহিষ্ণুতা; পানি, নদী, এবং শহুরে সহিষ্ণুতা: অবকাঠামো এবং বাস্তুতন্ত্র; নদী, সহিষ্ণুতা, এবং জনগণ; নদীর অধিকার: অববাহিকার সমন্বিত ব্যবস্থাপনা; বহুপাক্ষিক পানি সহযোগিতা এবং ন্যায্যতা; জীবন্ত যাদুঘর এবং স্থানীয় সম্প্রদায়গুলোর সহিষ্ণুতা; পানি এবং নদী: তরুণদের সম্পৃক্ততা টেকসই ভবিষ্যৎ: প্রযুক্তিগত সমাধান তৈরি।
বাংলাদেশে অস্ট্রেলিয়ার ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার নার্দিয়া সিম্পসন বলেন, জলবায়ু ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে কূটনীতিক ও নীতিনির্ধারকদের বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। আমরা ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং দুর্যোগ দেখতে পাচ্ছি। বাংলাদেশও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ, তবে একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজনের রোল মডেল। বাংলাদেশে আমরা সরকারের সঙ্গে কৃষি খাত উন্নয়ন এবং পানি ব্যবস্থাপনার জন্য বিভিন্ন এনজিওর সঙ্গে কাজ করছি। আমরা উদীয়মান নেতাদের জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই।
উদ্বোধনী বক্তব্যে একশনএইড বাংলাদেশ-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উচ্চ ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এ সমস্যা মোকাবিলায় অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। এখন এমন একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যা বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারকে একত্র করে, নতুন ধারণার জন্ম দেবে এবং স্থানীয় কমিউনিটি কী করতে পারে এবং কী করতে চায় তার ওপর জোর দেবে। আমাদের পানি ও নদী ব্যবস্থাপনায় নারী ও তরুণদের সম্পৃক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ। অধিকন্তু, একটি নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত এবং জলবায়ু কর্মীদের সাহায্য করতে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে।
সম্মেলনের প্রথম দিনে অ্যাকশন এইড ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ সোসাইটির চেয়ারপারসন ইব্রাহিম খলিল আল জায়াদ বলেন, বাংলাদেশে ৮০০ টিরও বেশি নদী রয়েছে। কিন্তু আমরা দেখতে পাই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মানুষ তাদের নিজের ভিটা থেকে বাস্তুচ্যুত হতে। আমরা ক্রমবর্ধমান জোয়ার, অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের ধরন এবং শুষ্ক ভূমি দেখতে পাই যেখানে কমউনিটির মানুষজন সংগ্রাম করছে। কিন্তু আমরা মানুষের উদ্যম, তাদের সহিষ্ণুতাও দেখতে পাই এবং এর জন্যই আমরা এখানে একত্র হয়েছি। এ সম্মেলন থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও সুপারিশ জলবায়ু ন্যয্যতায় অনন্য ভূমিকা রাখবে বলে আমি বিশ্বাস করি ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন ভূরাজনীতিতে বড় ভূমিকা পালন করে। গাজা যুদ্ধের প্রথম দুই মাসে উৎপন্ন বিশ্ব-উষ্ণায়ন নির্গমন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশের ২০টিরও বেশি বার্ষিক কার্বন ফুটপ্রিন্টের চেয়েও বেশি। জলবায়ু ভবিষ্যতকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষাগত, মনস্তাত্ত্বিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে মূলধারায় যুক্ত করা দরকার।
প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ তার বক্তব্যে বলেন, আমাদের জনসংখ্যা বাড়ছে এবং একই সঙ্গে পানির স্তর কমছে। সুতরাং আমরা পানির অপচয় বা দূষণ কমাতে আমাদের সচেতনতা প্রয়োজন। আমরা ৩টি প্রধান নদী ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছি এবং আমাদের পানির ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে। অধিকন্তু, বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত পানির ৯২ শতাংশই আসে বাইরের দেশ থেকে। আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলও খুব নিচু। এসবই জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় দেশের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।
তিনি আরও বলেন, যদি আমরা নীতি ও কর্মকাণ্ডে আসি, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় প্রণীত জলবায়ু পরিবর্তন বা পানি ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত ২৬টি নীতি ও আইন রয়েছে, কিন্তু নীতিমালার বিষয়বস্তু কী তা অধিকাংশ মন্ত্রণালয় বা সংস্থা জানে না। সেখানে কাজগুলো সমন্বিতভাবে হয় না। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তাদের গল্প বলতে হবে, অন্যথায় প্রকৃত সমস্যার সমাধান কখনোই হবে না।
প্রথম দিনের সম্মেলনে বিশেষজ্ঞরা নদী ও পানি বিষয়ক বক্তব্য ও বিভিন্ন প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৪, ২০২৪
টি আর/জেএইচ