রাজবাড়ী: রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ উপজেলার পদ্মা নদী তীরবর্তী চরাঞ্চলগুলোতে উপদ্রব বেড়েছে রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপের। বিষাক্ত এ সাপের দংশনে গত দেড় মাসে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে।
সাপ আতঙ্কে ক্ষেতে যেতে সাহস পাচ্ছেন না কৃষকরা। ফলে ক্ষেতের ফসল ক্ষেতেই নষ্ট হওয়ার উপক্রম। এমন পরিস্থিতিতে কৃষকদের মাঝে গামবুট বিতরণের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। আর কেউ আক্রান্ত হলে দ্রুত হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ চিকিৎসকদের।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার উজানচর ইউনিয়নের চর মজলিশপুর, মহিদাপুর, দেবীপুর, দৌলতদিয়া ইউনিয়নের চর করনেশনা, আংকের শেখের পাড়াসহ চরাঞ্চলগুলোতে সাপের উপদ্রব দেখা দিয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, গত ৮ এপ্রিল চর মজলিশপুর এলাকায় মাঠ থেকে ভুট্টা তোলার সময় সাঈদুল শেখ নামের এক কৃষককে সাপ দংশন করে। প্রথমে তাকে ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি দেখে সেখান থেকে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক সপ্তাহ পর তিনি মারা যান। তার আগে ২৯ মার্চ চর দেবীপুর মাঠে ময়না বেগম নামের এক গৃহবধূকে সাপ সাপ দংশন করে। চিকিৎসা নেওয়ার প্রায় দুই সপ্তাহ পর নিজ বাড়িতে তিনি মারা যান।
মজলিশপুর এলাকার মাতুব্বর আজিজুল মোল্লা জানান, গত ২৭ মে দুপুরে মাঠে কাজ করার সময় কৃষক শামীম শেখসহ কয়েকজন পদ্মা নদী থেকে একটি নৌকা টেনে তীরে তুলছিলেন। নৌকার নিচে থাকা রাসেলস ভাইপার সাপ শামীমের পায়ে সাপ দংশন করে। লোকজন সাপটি মেরে তাকে ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। পরদিন বিকেলে শামীম মারা যান। এরপর ধান কাটার সময় কৃষকেরা কয়েকটি রাসেলস ভাইপার পিটিয়ে মারেন। এখন ভয়ে কেউ ক্ষেতে বা নদী তীরে নামতে সাহস পাচ্ছেন না।
উপজেলার উজানচর ইউনিয়নের ইউপি সদস্য শেখ রাসেল মাহমুদ বলেন, পুরো চরাঞ্চলজুড়ে রাসেলস ভাইপার সাপের কারণে কৃষকদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। কেউ মাঠে যেতে চাচ্ছে না এবং ধান, ভুট্টা কাটতে শ্রমিকও পাচ্ছেন না। মাঝেমধ্যে কৃষকেরা সাপ দেখে পিটিয়ে মেরে ফেলে মাটিতে পুঁতে ফেলছেন। প্রশাসনিকভাবে ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।
উজানচর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. গোলজার হোসেন মৃধা বলেন, কৃষকেরা ক্ষেতে কাজ করতে গিয়ে রাসেলস ভাইপার সাপের আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। ইতোমধ্যে এ সাপের দংশনে তিনজন মারা গেছেন। এখন ভয়ে কেউ মাঠে যেতে চাচ্ছেন না। এ কারণে ক্ষেতে এখনো ধান ও ভুট্টা পড়ে আছে। এতে করে কৃষকদের অনেক ক্ষতি হচ্ছে।
গোয়ালন্দ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. শরিফুল ইসলাম বলেন, গত মার্চ মাসে একজন, এপ্রিলে একজন ও মে মাসে দুজন সাপে কাটা রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়। মাঝেমধ্যে সাপে কাটা রোগী হাসপাতালে আসছেন। তবে এখন পর্যন্ত হাসপাতালে কেউ মারা যাননি। তাছাড়া আমাদের হাসপাতালে সাপেকাটা রোগীদের চিকিৎসায় অ্যান্টিভেনম ইনজেকশন রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, সাপে কাটা রোগী বা পরিবারের কেউ আতঙ্কিত না হয়ে রোগীকে ওঝার কাছে না নিয়ে সরাসরি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসতে হবে। সাপেকাটার পর সময়মতো চিকিৎসা দিতে পারলে রোগী বেঁচে যাবে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. খোকন উজ্জামান বলেন, কৃষকদের ধান কাটার সময় আগে লাঠি দিয়ে ধানগাছ নড়াচড়া করে নিশ্চিত হয়ে সতর্কতার সঙ্গে ধান কাটতে হবে। এছাড়া বিশেষ ধরনের জুতা পরেও মাঠে কাজ করা যেতে পারে। এতে সাপ কামড় দিলেও তা শরীরে লাগবে না।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জ্যোতি বিকাশ চন্দ্র বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে রাসেলস ভাইপারের মতো বিষধর সাপের উপদ্রব বাড়ায় আমরা কিছুটা চিন্তিত। উপজেলা পরিষদ থেকে প্রথম অবস্থায় চরাঞ্চলের ১০০ জন কৃষককে গামবুট জুতা দেওয়ার উদ্যোগ নেয়াও হয়েছে। এছাড়া সাপ বিশেষজ্ঞ এনে সমাবেশ করে কৃষকদের সচেতন করা হবে।
বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিশ্বে ভয়ংকর বিষধর সাপের তালিকায় শীর্ষ পাঁচে অবস্থান রাসেলস ভাইপারের। তবে হিংস্রতা আর ক্ষিপ্রতায় বিপন্ন প্রজাতির সাপটি সবার চেয়ে এগিয়ে। মাত্র এক সেকেন্ডের ১৬ ভাগের এক ভাগ সময়ে কাউকে কামড়ে বিষ ঢালতে পারে এই সাপ। শরীরে চাঁদের মতো ছাপ থাকায় বাংলাদেশে সাপটি চন্দ্রবোড়া নামেও পরিচিত। কিলিংমেশিন খ্যাত সাপটি ডিম পাড়ার পরিবর্তে সরাসরি বাচ্চা জন্ম দেয়। একটি স্ত্রী সাপ একবারে ৭০টি পর্যন্ত বাচ্চা জন্ম দেওয়ার সক্ষমতা রাখে।
বাংলাদেশ সময়: ১১২৫ ঘণ্টা, জুন ১০, ২০২৪
এসএএইচ