ঢাকা, রবিবার, ১৬ ভাদ্র ১৪৩১, ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৬ সফর ১৪৪৬

জাতীয়

উপসচিব পদে কোটা বাতিল চায় ‘আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১৮ ঘণ্টা, আগস্ট ৩১, ২০২৪

ঢাকা: উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদে কোটা পদ্ধতি বাতিল করে উন্মুক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে মেধার ভিত্তিতে উপসচিব পদে নিয়োগ দেওয়াসহ এক গুচ্ছ দাবি জানিয়েছে নব গঠিত ‘আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’।

বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) ২৫টি ক্যাডার নিয়ে গঠিত ‘আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’ শনিবার (৩১ আগস্ট) আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে এসব দাবি জানায়।

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে পরিষদ বৈষম্যহীন, জনবান্ধব ও জনকল্যাণমূলক সিভিল সার্ভিস গঠনে এক গুচ্ছ দাবি ও সুপারিশ পেশ করে।

‘আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’ এর উল্লেখযোগ্য দাবি ও সুপারিশগুলো হচ্ছে- উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদে কোটা পদ্ধতি বাতিল করে উন্মুক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে মেধার ভিত্তিতে উপসচিব পদে নিয়োগ দেওয়া, কৃত্য পেশাভিত্তিক মন্ত্রণালয় গঠন তথা ‘ক্যাডার যার মন্ত্রণালয় তার’ এর বাস্তবায়ন, প্রশাসন ক্যাডার ও অন্যান্য ক্যাডারের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য দূরীভূত করে সব ক্যাডারের মধ্যে সমতা আনয়ন, পদ সৃজন, স্কেল আপগ্রেডেশন ইত্যাদির মাধ্যমে পদোন্নতিতে সমান সুযোগ দেওয়া, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স এর পুনর্বিন্যাস বা সংশোধন, বিভিন্ন ক্যাডারের তফসিলভুক্ত পদ থেকে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার ইত্যাদি।

এছাড়া পরিষদের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বৈষম্যহীন মেধাভিত্তিক সিভিল সার্ভিস গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রশাসনিক সংস্কারের অংশ হিসেবে আরও যেসব দাবি/সুপারিশ পেশ করা হয়। সেগুলো হলো- জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনি দায়িত্ব প্রদানে জ্যেষ্ঠতা রক্ষা, বৈদেশিক প্রশিক্ষণ, উচ্চতর গবেষণা, শিক্ষা, শিক্ষা বৃত্তির ক্ষেত্রে সমতা আনয়ন, সুষমভাবে সরকারি বাসস্থান বরাদ্দ, পরিবহন সুবিধা, লিয়েন, ডেপুটেশন প্রদান, নিজ নিজ অধিক্ষেত্রে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ক্ষমতা প্রদান, প্রশাসনিক পদ পুনর্বিন্যাস বা পুনর্গঠন, ইত্যাদি।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের কর্মবিভাগের নিউক্লিয়াস হলো এর ক্যাডার সার্ভিসসমূহ। তার ওপরে রয়েছে সরকারের সুপিরিয়র সার্ভিস যা উপসচিব হতে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত বিন্যস্ত। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য উপযোগী কর্মবিভাগ নির্মাণের জন্য একটি কমিশন (পে অ্যান্ড সার্ভিসেস কমিশন) গঠন করা হয়। এরপর সংসদে ‘সার্ভিসেস (রিঅর্গানাইজেশন অ্যান্ড কন্ডিশনস) অ্যাক্ট, ১৯৭৫’ প্রণয়ন করে কর্মবিভাগ তৈরির জন্য সরকারকে ক্ষমতা দেওয়া হয়। এ আইনের অধীন ১৯৭৯ সালের ১ মার্চ সিনিয়র সার্ভিসেস পুল (এসএসপি) আদেশ জারি করা হয়। প্রজাতন্ত্রের কর্মবিভাগকে প্রতিনিধিত্বমূলক এবং প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এর গুণগত বিকাশের জন্য এ আদেশ ছিল একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ।

সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, ১৯৮০ সালের ১ সেপ্টেম্বর ২৮৬ নং এসআরও এর মাধ্যমে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসেস (পুনর্গঠন) আদেশ ১৯৮০ জারি করা হয়। এ আদেশে প্রজাতন্ত্রের সিভিল সার্ভিসকে ১৪টি সার্ভিস ক্যাডারে বিন্যস্ত করা হয় যার সংখ্যা বর্তমানে ২৬টি। এসএসপি এবং ক্যাডার সার্ভিস ছিল একে অপরের পরিপূরক। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো এসএসপি আদেশ কখনোই বাস্তবায়ন করা যায়নি। সচিবালয়ে অবস্থানগত সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে প্রশাসন ক্যাডার এ সার্ভিসটিকে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে। ১৯৮৯ সালে এসএসপি বাতিল হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ১০ বছরে একবারের জন্যও পরীক্ষার মাধ্যমে উপসচিব নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি।

আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ১৯৮৯ সালে এসএসপি বাতিল আদেশে (এসআরও ২৬১, ১৭ জুলাই) উপসচিব ও যুগ্মসচিব পদে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের পরিবর্তে বিভিন্ন ক্যাডারের জন্য প্রহসনমূলক কোটা পদ্ধতি চালু করা হয়। ১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে (১১ ফেব্রুয়ারি গেজেট নোটিফিকেশন জারি হয়) উপসচিবের পদে প্রশাসন ক্যাডারের জন্য ৭৫ শতাংশ কোটা রেখে অন্যান্য ক্যাডারের জন্য ২৫ শতাংশ কোটা বরাদ্দ রাখা হয়। বৈষম্যমূলক কোটা সংরক্ষণের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ হয়ে খাদ্য ও তথ্য ক্যাডারের কয়েকজন কর্মকর্তা হাইকোর্টে রিট মামলা করলে হাইকোর্ট ২০০২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি এ কোটা সংরক্ষণকে সম্পূর্ণ বেআইনি বলে রায় প্রদান করে। তবে ২০১০ সালের ২৪ মে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ ১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারির গেজেট নোটিফিকেশনটিকে বৈধ ঘোষণা করেন। কেউ কেউ মনে করেন আপিল বিভাগের আদেশের ফলে বিষয়টির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সংবিধানের ১৩৩ অনুচ্ছেদ এবং ‘সার্ভিসেস (রিঅর্গানাইজেশন অ্যান্ড কন্ডিশনস) অ্যাক্ট, ১৯৭৫’ এর ৪ নং দফার বিধান অনুযায়ী সরকার কেবলমাত্র একটি প্রজ্ঞাপন গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমেই এ বণ্টন ব্যবস্থা পরিবর্তন করতে পারে। কাজেই বিদ্যমান আইন অনুযায়ী বৈষম্য দূর করে নতুন আদেশ করার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই।

পরিষদের পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়, প্রজাতন্ত্রের জনপ্রশাসন সংস্কারে এ যাবত যতগুলি কমিশন ও কমিটি হয়েছে তার প্রতিটিই প্রজাতন্ত্রের পদসমূহে উন্মুক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। অথচ ২০১৮ সালের ১৪ নভেম্বর (সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ এর ৫৭ নং আইনের ৬১(১) এর (খ) এর মাধ্যমে ‘সার্ভিসেস (রিঅর্গানাইজেশন অ্যান্ড কন্ডিশনস) অ্যাক্ট, ১৯৭৫’ রহিত করা হয় এবং ২০২৪ সালে বাংলাদেশ গেজেট, অতিরিক্ত, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ এর (৩) ধারা মোতাবেক সরকারের উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদ প্রশাসন ক্যাডারের তফসিলভুক্ত করে গেজেট প্রকাশ করে। এর মাধ্যমে সরকারের উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদে মেধার ভিত্তিতে পদায়নের সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মেধার যথাযথ মূল্যায়ন ও বৈষম্যহীন জনবান্ধব সিভিল প্রশাসন গড়তে এসএসপি প্রথা পুনরায় চালু করে মেধার ভিত্তিতে উপসচিব পদে নিয়োগ দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

সংবাদ সম্মেলনে পরিষদের নেতারা বলেন, সরকারের নির্দিষ্ট সেক্টরের পরিকল্পনা গ্রহণ, নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ক্যাডার সার্ভিস গঠিত হয়। একটি বিশেষ ক্যাডার সার্ভিস তাকেই বলা হয় যার ল্যাডার থাকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ পদ পর্যন্ত। অর্থাৎ একটা ক্যাডারভুক্ত সদস্যরাই অভিজ্ঞতা অর্জন ও পদোন্নতির মাধ্যমে নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ ধাপ পর্যন্ত যাওয়ার অধিকারী হবেন। সংশ্লিষ্ট বিভাগের সমস্যার খুঁটিনাটি, সমাধান কৌশল, সময়োপযোগী নীতি নির্ধারণ, পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন কৌশল সংশ্লিষ্ট ক্যাডার কর্মকর্তারা যেভাবে বুঝতে পারবেন, অন্য কোনো ক্যাডার কর্মকর্তাদের পক্ষে সেটা ভালোভাবে জানা ও বোঝা সম্ভব নয়।

তাছাড়া ‘আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’ পদোন্নতি বৈষম্য নিরসনের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত জনসেবা নিশ্চিত করতে সব ক্যাডারের কর্মকর্তাদের ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতি, সুপারনিউমারারি (ইনসিটু) ও ভূতাপেক্ষিক পদোন্নতির ব্যবস্থা গ্রহণ, সব ক্যাডারের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় গ্রেডের পদ সৃজন, পদসোপান তৈরি করে পদসমূহ আপগ্রেডেশন এর দাবি/সুপারিশ তুলে ধরে।

বাংলাদেশ বেতারের অতিরিক্ত মহাপরিচালক এ এস এম জাহিদের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে দাবি ও সুপারিশসমূহ উপস্থাপনা করেন বিসিএস (শিক্ষা) ক্যাডারের সহযোগী অধ্যাপক ফারহানা আক্তার। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিসিএস (তথ্য) ক্যাডারের মোহাম্মদ ওমর ফারুক দেওয়ান, মনির হোসেন, বিসিএস (শিক্ষা) ক্যাডারের ড. আহসান হাবীব, ড. মো. মফিজুর রহমানসহ বিভিন্ন ক্যাডারের প্রতিনিধিরা।

বাংলাদেশ সময়: ২১১৮ ঘণ্টা, আগস্ট ৩১, ২০২৪
টিএ/এমআইএইচ/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।