খাগড়াছড়ি: তিন দিন ধরে অশান্ত দেশের পাহাড়ি অঞ্চল। গত বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) ভোরে চোর সন্দেহে খাগড়াছড়িতে মামুন (৩০) নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে।
ফেসবুকে গুজব, অপতথ্য ও ভুল ছবি ছড়ানোর পাশাপাশি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সহিংসতাও বাড়তে থাকে। শেষ পর্যন্ত বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) রাত থেকে শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) দুপুর পর্যন্ত খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে চারজনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ওই দুই জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করতে হয়েছে প্রশাসনকে।
ঘটনাপ্রবাহে দেখা যায়, মামুনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার পর কিছুটা উত্তেজনা বিরাজ করলেও বৃহস্পতিবার তা সংঘাতে রূপ নেয়। ওই হত্যার ঘটনায় সেদিন বিকেলে দিঘীনালার কলেজ গেইট এলাকা থেকে একটি মিছিল বের করা হয়। দিঘীনালা ডিগ্রি কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে আয়োজিত মিছিলটি উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে লারমা স্কোয়ারে যেতে চাইলে দুর্বৃত্তরা হামলা চালায়। এসময় শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে বেশ কয়েক রাউন্ড গুলিও করা হয়। তখন লারমা স্কোয়ার সংলগ্ন দোকানপাটে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী, পুলিশসহ স্থানীয়রা মিলে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
এই ঘটনাটির পর সন্ধ্যা হতেই ছড়াতে থাকে গুজব। ছড়াতে থাকে আতঙ্ক ও উত্তেজনা। রাত বাড়তেই নানা গুজবে সয়লাব হয় ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। কতিপয় ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ও পেজ থেকে উসকানিমূলক ছবি ও পোস্ট দিয়ে এলাকাবাসীকে উত্তেজিত করা হতে থাকে। এমনও চেষ্টা করা হয়েছে, যাতে উত্তেজিত তরুণরা রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়। ফলে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় নির্ঘুম রাত কাটাতে হয় জেলাবাসীকে।
এই রাতের পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) শুক্রবার বলেছে, খাগড়াছড়ি জোনের একটি টহল দল বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টায় একজন মুমূর্ষ রোগীকে স্থানান্তরের সময় খাগড়াছড়ি শহরের স্বনির্ভর এলাকায় পৌঁছালে অবস্থানরত উত্তেজিত জনসাধারণ ইউপিডিএফের (মূল) নেতৃত্বে বাধা সৃষ্টি করে। এক সময় ইউপিডিএফের (মূল) সন্ত্রাসীরা সেনাবাহিনীর টহল দলের সদস্যদের ওপর গুলি করে এবং আত্মরক্ষার্থে সেনাবাহিনী পাল্টা গুলি চালায়। ওই গোলাগুলির ঘটনায় তিনজন নিহত এবং কয়েকজন আহত হয় বলে জানা যায়।
একই ঘটনার ধারাবাহিকতায় খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়িতে স্থানীয় উচ্ছৃঙ্খল জনসাধারণ কয়েকজন যুবকের মোটরসাইকেল থামিয়ে তাদের ওপর হামলা ও লাঠিপেটা করে। সেই সঙ্গে উত্তেজিত জনসাধারণ ইউপিডিএফের (মূল) নেতৃত্বে ফায়ার ব্রিগেডের অফিসে ভাঙচুর করে।
‘যার যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে গুজব ছড়াচ্ছে’
খাগড়াছড়ির পরিস্থিতির বিষয়ে দীঘিনালা প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মো. আল আমিন বলেন, ‘দীঘিনালায় দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি হামলায় আহত হয়েছে ছয়জন। অথচ ফেসবুকে গুজব ছড়াচ্ছে পাঁচজন মারা গেছে। শুধু লারমা স্কোয়ার সংলগ্ন এলাকায় পাহাড়ি ও বাঙালির ১০৫টি ছোট-বড় দোকান পুড়েছে। অথচ বলা হচ্ছে দীঘিনালায় গ্রামে গ্রামে আগুন দেওয়া হচ্ছে। এসব গুজবে মানুষ বেশি আতঙ্কিত। যার যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে গুজব ছড়াচ্ছে। শুধু ঘটনাকেন্দ্রিক থাকলে পরিস্থিতি এতটা খারাপ হতো না। ’
জেলার মিলনপুর এলাকার বাসিন্দা অর্ণব চাকমা বলেন, ‘আমাদের এলাকার পরিবেশ ভালো আছে। কিন্তু নানাভাবে ছড়ানো হয় যে রাতে হামলা হতে পারে। আমরা সারারাত জেগে ছিলাম। সবাই আতঙ্কে রাত কাটিয়েছি। একজনকে পিটিয়ে মেরেছে। তার বিচার চাইতে পারে। কিন্তু সেটি তো সাম্প্রদায়িক ইস্যু হতে পারে না। ’
অন্যদিকে খাগড়াছড়ির ঘটনা উত্তেজনা ছড়ায় রাঙামাটিতেও। সেই উত্তেজনার ধারাবাহিকতায় শুক্রবার সেখানে সংঘর্ষও হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সকালে পাহাড়ি ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে রাঙামাটি শহরের বনরূপা এসে বেশ কয়েকটি গাড়ি ও দোকানে হামলা চালায়। খবর পেয়ে বাঙালি ও ব্যবসায়ীরা প্রতিরোধের চেষ্টা করলে উভয়পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে একজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছে উভয়পক্ষের ৫৩ জন।
রাঙামাটির ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আইএসপিআর বলেছে, সকালে পিসিজেএসএস সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ রাঙ্গামাটি জেলা সদরে ‘সংঘাত ও বৈষম্যবিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন’র ব্যানারে স্থানীয় জনসাধারণ রাঙ্গামাটি জিমনেশিয়াম এলাকায় সমবেত হয়। এ সময় ৮০০-১০০০ জন উত্তেজিত লোক একটি মিছিল বের করে বনরুপা এলাকার দিকে অগ্রসর হয় এবং বনরুপা বাজার মসজিদ, অগ্রণী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, সিএনজি-অটোরিক্সা, মোটরসাইকেল এবং বেশকিছু দোকানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এতে বেঁধে যাওয়া সংঘর্ষে উভয় পক্ষের বেশকিছু লোকজন আহত হয়।
‘পাহাড়কে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র’
এদিকে চলমান পরিস্থিতিতে ইস্যু তৈরি করে পাহাড়কে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র দেখছেন অনেকে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আসাদ উল্লাহ বলেন, ‘পাহাড় নিয়ে বহু বছর ধরে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র চলে আসছে। সশস্ত্র সংগঠনগুলো সাম্প্রদায়িক সংকট তৈরি করে পাহাড়কে অস্থির রাখতে চায়। এসব ঘটনা ঘটিয়ে তারা বাংলাদেশ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামকে আলাদা করে জুমল্যান্ড করার স্বপ্ন দেখছে। এখানে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলো অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করছে। এখনই এসব বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। ’
নিরাপত্তা জোরদার, ১৪৪ ধারা জারি
সহিংসতার পর খাগড়াছড়ি-রাঙামাটিসহ পার্বত্যাঞ্চলজুড়ে জোরদার করা হয়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পরিস্থিতি শান্ত রাখতে কাজ করছে সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান জানান, আমাদের সবাইকে সচেতন থেকে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। কেউ যেন গুজবে কান না দেয়। বর্তমানে জেলার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। শান্তি-সম্প্রীতি রক্ষায় প্রত্যেককে সংযতভাবে চলার আহ্বান জানাই।
রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান বলেন, সকাল থেকে রাঙামাটি শহরে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার উদ্ভব ঘটেছে। তাই ১৪৪ ধারা মোতায়েন করা হয়েছে। এই আদেশ পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। এছাড়া রাঙামাটি শহরে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
প্রকৃত দোষীদের শনাক্ত করে ব্যবস্থার আশ্বাস
চলমান উত্তেজনা তিন পার্বত্য জেলায় ভয়াবহ দাঙ্গায় রূপ নিতে পারে উল্লেখ করে আইএসপিআর থেকে বলা হয়, অনতিবিলম্বে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গকে চলমান উত্তেজনা প্রশমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য অনুরোধ জানানো যাচ্ছে। যথাযথ তদন্ত কার্যক্রম সম্পাদনের মাধ্যমে প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের শনাক্তপূর্বক প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিন পার্বত্য জেলায় শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে সর্বসাধারণকে বিশেষভাবে অনুরোধ জানানো যাচ্ছে।
শান্ত থাকার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার
তিন পার্বত্য জেলায় সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। পাশাপাশি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছে বলেও জানানো হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, গতকাল বৃহস্পতিবার খাগড়াছড়ি ও আজ শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) রাঙামাটিতে সৃষ্ট সমস্যা নিরসনে আন্তরিকভাবে কাজ করছে সরকার। ১৮ সেপ্টেম্বর জনৈক ব্যক্তিকে গণপিটুনি ও পরে তার মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে চলমান হামলা, আক্রমণ ও প্রাণহানির ঘটনায় সরকার গভীরভাবে দুঃখিত এবং ব্যথিত।
সরকারের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সব বাহিনীকে সর্বোচ্চ সংযম দেখাতে এবং পার্বত্য তিন জেলায় বসবাসকারী জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেখানে শান্তি, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি নিশ্চিতকরণে সরকার বদ্ধপরিকর।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে আরও বলা হয়, আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়া এবং ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত না হওয়ার জন্য সবাইকে নির্দেশ দেওয়া যাচ্ছে। আইন নিজ হাতে তুলে নেওয়া এবং যে কোনো সম্পত্তি ধ্বংস করা দণ্ডনীয় ও গর্হিত অপরাধ।
সহিংসতার সঙ্গে সম্পর্কিত সব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত আর দায়ী ব্যক্তিদের বিচার নিশ্চিত করা হবে। এ লক্ষ্যে একটি শক্তিশালী তদন্ত কমিটি খুব শিগগির গঠন করা হবে। আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
প্রেস উইং আরও জানায়, আগামীকাল শনিবার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার নেতৃত্বে সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি পরিদর্শন করবেন। এই প্রতিনিধি দলে থাকছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক উপদেষ্টা, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা এবং প্রতিরক্ষা ও জাতীয় সংহতি উন্নয়ন বিষয়ক প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী।
বাংলাদেশ সময়: ২০৫৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২০, ২০২৪
এডি/এইচএ/