ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

‘যদি মারা যাই, মানুষ তোমাদেরকে শহীদের স্ত্রী-সন্তান বলে ডাকবে’

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২৪
‘যদি মারা যাই, মানুষ তোমাদেরকে শহীদের স্ত্রী-সন্তান বলে ডাকবে’ আন্দোলনে গিয়ে নিহত মাসরুরের স্ত্রী-সন্তান। ইনসেটে মাজহারুল ইসলাম মাসরুর

লক্ষ্মীপুর: স্বামী মাসরুরকে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যেতে নিষেধ করেছিলেন স্ত্রী বিবি সালমা।  

এ সময় সহধর্মিণীকে থামিয়ে দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আন্দোলনে গেলে শহীদ হব।

আমার সন্তানকে আমি আন্দোলনে নিয়ে যাব। আমার সন্তানকে সামনে রাখব, আমি পেছনে থাকব। আমি যদি মারা যাই, তখন মানুষ তোমাদেরকে শহীদের স্ত্রী-সন্তান বলে ডাকবে। আর আমার সন্তান মারা গেলে, তখন সবাই আমাদেরকে শহীদের বাবা-মা বলে ডাকবে’।  

গত ৫ আগস্ট গাজীপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন মাসরুর।  

বাবাহারা নবজাতককে কোলে নিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে নিহত মাসরুরের স্ত্রী সালমা এসব কথা জানান।

লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের বাসিন্দা মাসরুর। তার পুরো না মাজহারুল ইসলাম মাসরুর ওরফে আলী আজগর (২৯)। তিনি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।  

লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার পাটওয়ারীর হাট ইউনিয়নের চরবড়ালিয়া গ্রামের এলাকার বৃদ্ধ আবদুল খালেকের ছেলে মাসরুর। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেন। পরে পোলট্রি খামার ও ইলেক্ট্রিক সরঞ্জামের ব্যবসাও করেছেন। তবে কোথাও স্থায়ী হতে পারেননি।  

সবশেষ প্রায় ৭ মাস আগে গাজীপুরে শ্বশুর মো. মোস্তফার কাছে যান ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে যান মাসরুর। সেখানে ব্যবসায় ভালোই চলছিল তার। স্বৈরাচারী সরকার পতনের আন্দোলনে সবসময় সক্রিয় ছিলেন তিনি। মাসরুর ইসলামী আন্দোলনের পাটওয়ারীর হাট ইউনিয়ন শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।

মাসরুর যখন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় তখন তার স্ত্রী ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। মাসরুরের মৃত্যুর ঠিক দেড় মাস পর গত রোববার (২২ সেপ্টেম্বর) তার স্ত্রীর কোলজুড়ে ফুটফুটে ছেলেসন্তান জন্ম নেয়। এখনও নবজাতকের নাম রাখা হয়নি।  

সাড়ে ৩ বছর বয়সী নাফিজা আক্তার নামে আরও এক কন্যাসন্তান রয়েছে মাসরুরের। প্রতিদিন বাবার সঙ্গে মোবাইলফোনে কথা বলতো সে। গত দেড় মাস ধরে নাফিজার সঙ্গে তার বাবার কথা হয় না। বাবার কথা জিজ্ঞেস করতেই তার দুই চোখ পানিতে ভিজে যায়। ছোট্ট নাফিজা বাবা হারানোর বেদনা কী তাও বুঝতে পারছে না। তবে বাড়িতে সবার উপস্থিতিতে তার দুই চোখ শুধু বাবাকে খুঁজে বেড়ায়। কোনো একদিন হয়তো তার বাবা এসে তাকে কোলে নেবে এই আশায়।  

সালমা এখন তার বাবার বাড়ি কমলনগর উপজেলার চরফলকন ইউনিয়নের ফলকন গ্রামে থাকছেন। বাবাহারা দুই সন্তানের ভবিষ্যৎ এখন কালো মেঘে ঢাকা।  

নিহত মাসরুর স্ত্রী সালমা বলেন, স্বামী আমাকে বলেছিলেন আন্দোলনে তার সঙ্গী হতে। আমাকে আন্দোলনে যেতে বুঝিয়ে গেছেন। কমলনগরের হাজিরহাট বাজারে মিছিল হবে, আমাকে যেতে বলেছিলেন। তবে সঙ্গে আমার সন্তানকে নিতে বলেছিলেন। এখন সবাই আছে, শুধু তিনি নেই। কিন্তু সামনে দিকে আমাদের পরিস্থিতি পুরো অন্ধকার। এখন যেমন-তেমন ভাবে আছি। আল্লাহপাক জানেন, ভবিষ্যতে কী অবস্থায় আমি ছেলেমেয়েকে নিয়ে থাকব।

ঘটনার দিনই স্ত্রী সালমার সঙ্গে মাসরুরের কথা হয়। তখন মাসরুর দোকানে ছিলেন। সালমাকে তিনি জানিয়েছেন, তিনি আন্দোলনে যাবেন। সালমা খাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে আন্দোলনে যাব, তারপর খাওয়া-ধাওয়া করব। পরে সালমা তার ভাইয়ের কাছে জানতে পারেন মাসরুর মারা গেছেন।

মাসরুরের শিক্ষকতা জীবনের সহকর্মী সিরাজুল ইসলাম মেহরাজ বলেন, ঘটনার দিন মাসরুরের এক বন্ধুকে বলেছিল- গুলিবিদ্ধ কেউ একজনকে তিনি হাসপাতাল নিয়ে যাচ্ছেন। বলেছিলেন গুলিবিদ্ধ লোকটি তার বন্ধু ছিল। এরপর আর তার সঙ্গে কোনো কথা হয়নি। পরে গাজীপুরের শহীদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে তার মরদেহ পাওয়া যায়। ধারণা করছি- গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরিবার বা আত্মীয়-স্বজনদের দুশ্চিন্তায় না ফেলতে তিনি ঘটনাটি লুকিয়েছেন।

মাসরুরের ছোট ভাই হুমায়ুন কবির বলেন, আমার ভাই জীবনে অনেক কষ্ট করেছে। নিজে পড়ালেখা করেছে। পাশাপাশি আমাদের জন্য কষ্ট করেছেন। তিনি একটি মাদরাসা করেছেন। পরে ওই মাদরাসার দায়িত্ব আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে তিনি গাজীপুরে ব্যবসা করতে যান। আমার ভাই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। তার পেটে ও পিঠে দুটি গুলির চিহ্ন দেখা গেছে।

মাসরুরের চাচা শ্বশুর ওমর ফারুক বলেন, মাসরুর আর্থিকভাবে তেমন একটা স্বাবলম্বী ছিল না। গাজীপুর যাওয়ার আগে তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে শ্বশুর বাড়িতে রেখে যায়। এখন তো কোনোভাবে দিন কাটছে তাদের। সামনে তারা কীভাবে চলবে, যতই সময় যাচ্ছে- তা নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে। সরকার যদি পরিবারটির দিকে মুখ তুলে তাকায়, হয়তো মাসরুরের স্ত্রী সালমা ছেলেমেয়েকে নিয়ে স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করতে পারবে।

মাসরুরের কথা জিজ্ঞেস করতেই তার বৃদ্ধ বাবা আবদুল খালেক কান্নায় ভেঙে পড়েন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, মাসরুর সবার চেয়ে ভালো ছিল। পরিবারের সবার দেখভাল করতো। আন্দোলনে গিয়ে সে মারা গেছে। সে শহীদ হয়েছে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২৪
এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।