ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

বুড়ি তিস্তার জলাধার খননে বিরোধের শেষ কোথায়?

মো. আমিরুজ্জামান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৩৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৪, ২০২৪
বুড়ি তিস্তার জলাধার খননে বিরোধের শেষ কোথায়? বুড়ি তিস্তার জলাধার

নীলফামারী: নীলফামারীর ডিমলায় বুড়ি তিস্তার জলাধার খননে স্থানীয়দের সঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিরোধ তুঙ্গে উঠেছে। কৃষকদের সেচ সুবিধা নিশ্চিতে পানি উন্নয়ন বোর্ড বুড়ি তিস্তার জলাধার খননের প্রকল্প হাতে নিয়েছে অধিগ্রহণ করা ১২১৭ দশমিক ৬১ একর জমিতে।

 

তিন হাজার ১৫৮ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা নিশ্চিতে প্রকল্পটি ২০২১ সালে একনেকে পাস হয়। তারপরেই কার্যক্রম চালু হলে স্থানীয়দের বাধার মুখে পড়তে হয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে।  

হামলা ও ভাঙচুরে স্থানীয়দের নামে মামলাও হয় বেশ কয়েকটি। কিন্তু স্থানীয়দের দাবি, পানি উন্নয়ন বোর্ড অধিগ্রহণের টাকা দিয়েছে মাত্র ১০৪ একর জমির। এদিকে আবার পানি উন্নয়ন বোর্ডেরও বিএস রেকর্ড মূলে রয়েছে প্রায় সাড়ে ৯শ একর জমি। স্থানীয়রা বলছেন, প্রকল্পটি ষাটের দশকে বাস্তবায়নের পর থেকেই প্রায় পাঁচ বছর ডুবে ছিল স্থানীয়দের ফসলি জমি। কারণে ১৯৬৯ সালের ২৫ জুন ফসলের ক্ষতিপূরণও দেওয়া হয়েছিল ক্ষতিগ্রস্তদের। কিন্তু বর্তমানে এ জমিতে আবাদ হচ্ছে ধান-আলু, মরিচ-পেঁয়াজসহ বছরে তিন থেকে চারটি ফসল। এই জমিজুড়ে আছে ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার পাঁচটি মৌজা।

স্থানীয়রা বলছেন, এসব জমিতে চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করে পাঁচ মৌজার মানুষ। কারণে প্রকল্পটি বাতিলসহ মামলাগুলো প্রত্যাহারের দাবি তাদের।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বুড়ি তিস্তার পাশ ঘেঁষা জমিতে বিভিন্ন ফসলের আবাদ হচ্ছে। ব্যারেজ এলাকায় দেখা গেছে জলাধার খননের জন্য প্রস্তুত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এসব ফসলি জমি রক্ষার্থে দফায় দফায় মানববন্ধন-বিক্ষোভও করেছেন স্থানীয়রা। প্রকল্প বাতিলের দাবিতে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন তারা।

এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডও আবার মানববন্ধন করেছে প্রকল্পে বাধা প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে। মানববন্ধনে তারা প্রায় দেড় বছর ধরে ঝুলে থাকা প্রকল্পটির কাজ অব্যাহত রাখার দাবি জানান।  

৭৫ ঊর্ধ্ব কুঠির ডাঙ্গা মৌজার কৃষক আব্দুর রউফ বলেন, আইয়ুব খানের আমলে কালীগঞ্জে বুড়ি তিস্তা ব্যারেজ নির্মাণ করা হয়। ব্যারেজটি নির্মাণের পর থেকে কোনো কাজে আসেনি। গেট বন্ধ করে রাখায় পাঁচ বছর আশ-পাশের জমিতে আবাদ হয়নি। কারণে ফসলের ক্ষতিপূরণ বাবদ আমাদের ৬৯ সালে টাকা দেওয়া হয়েছিল। আমরাতো অধিগ্রহণের টাকা পায়নি। এ জমিতে আমরা বছরে তিন-চারটি ফসল ফলাই। এখন এই জমিতে নাকি জলাধার খনন করবে! বাধা দিতে গেলে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য (এমপি) আফতাব উদ্দিন সরকার মিলে আমাদের ওপর নানা নির্যাতন করে। নিরীহ লোকদের আসামি করেন তারা। সেই থেকে আমরা চরম আতঙ্কে আছি। পুলিশের তাড়ায় ঠিকভাবে বাড়িতেও থাকতে পারছি না। আমরা চাই এই প্রকল্পটি বাতিল হোক। এতগুলো ফসলি জমি নষ্ট করে কীভাবে জলাধার তৈরির অনুমতি দিয়েছে হাসিনা সরকার।

রামডাঙ্গা মৌজার অলিয়ার রহমান বলেন, আমরা জলঢাকা ও ডিমলা উপজেলাবাসী শান্তিতে বসবাস করছিলাম। ৪০ ও ৬২ রেকর্ডে এ জমি আমাদের বাপ-দাদার নামেই ছিল। কোনো জলাধার বা নদী ছিল না। ব্যারেজ নির্মাণ করে আমাদের প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। তাদের এই প্রকল্পে কখনো উন্নতি দেখিনি। তারা পানি আটকিয়ে আমাদের ভাতে মেরেছে। তারা কোনো ফল পায়নি। পরে তারা এখানে মাছ চাষ শুরু করে। তারপরেও তাদের সফলতা নেই। এখন তারা এখানে আবার জলাধার খনন করার চেষ্টা করছে। আমরা বাধা দিয়েছে বলে আমাদের অন্যায়ভাবে স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের দোসর এই আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আফতাব উদ্দিন সরকারের দাপটে বিভিন্ন মামলার আসামি করে হয়রানি করা হচ্ছে। আমরা চাই এই ভুয়া প্রকল্প বাতিল করে আমাদের খেয়ে বাঁচতে দেন। আমাদের শান্তিতে থাকতে দেন।

জলঢাকার চিড়াভিজা গোলনার আব্দুর রসিদ বলেন, ব্যারেজ নির্মাণের পরে আমাদের বাপ-দাদার জমিতে পানিতে ডুবে যায়। সেই সময়ে আমাদের চরম দুর্দিন গেছে। বাইরে গিয়ে কাজ করে খেয়ে না খেয়ে থাকতে হয়েছে। ফসল তলিয়ে যাওয়ায় জলাধার থেকে শাপলা ফুলের ঢ্যাব তুলে খেতে হয়েছে। কিন্তু তারা ফসলের ক্ষতিপূরণের টাকা দিয়ে জমির মালিকানা দাবি করছে। এখন তারা এই জমিতে জলাধার খনন করতে চায়। তারা জলাধারে পানি জমিয়ে পেছনের জমিতে সেচ দেবে মাত্র একবার। আর আমরা এই জমিতে ফসল ফসলাচ্ছি তিন থেকে চার বার। আমরা চাই এই প্রকল্প বাতিল করে আমাদের স্বাভাবিকভাবে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ করে দেওয়া হোক। এই জমিতে জলাধার খনন হলে আবারও আমাদের খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হবে।  

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আতিকুর রহমান বলেন, আপনারা জানেন বুড়ি তিস্তার জলাধার খননে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছে। রিজার্ভারের জন্য ও বুড়ি তিস্তার জন্য জমি অধিগ্রহণ ১৯৫৬-৫৭ সাল থেকেই শুরু হয়েছে। ১৯৯২-৯৩ সালে অধিগ্রহণের কাজ শেষ হয়েছে। আমরা ১৭টি এলেকেসের মাধ্যমে ১২১৭ দশমিক ৬১ একর জায়গা অধিগ্রহণ করেছি। বর্তমানে আমাদের অধিগ্রহণ করা জায়গায় স্থানীয়দের ১৭টি স্থাপনা রয়েছে। অধিগ্রহণ জায়গার ৬৬৭ একরে জলাধার খনন হবে। এই খনন কাজের চলাকালে বিভিন্ন সময়ে আমরা স্থানীয়দের কাছে হামলার শিকার হয়েছি। এজন্য ডিমলা থানায় একটি, জলঢাকা থানায় ছয়টি ও আদালতে তিন মামলা করা হয়েছে। মামলায় ৩০ থেকে ৬০ জনকে নামীয় আসামি আর বাকি কিছু অজ্ঞাতপরিচয় আসামিও রয়েছে। এটি একটি সরকারের লাভজনক প্রকল্প। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে প্রতিবছর অতিরিক্ত ফসল উৎপাদন হবে ২৬ লাখ মেট্রিক টন, সাড়ে ১৫ কোটি টাকার জ্বালানি সাশ্রয়, সারের সাশ্রয় দুই কোটি টাকার আর এতে পরিবেশেরও ভারসাম্য রক্ষা হবে। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সবার সহযোগিতা চান তিনি।  

জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ নায়িরুজ্জামান বলেন, বুড়ি তিস্তার জলাধার খনন কাজ দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে। আমরা আসার পর থেকে এটি নিয়ে কাজ করছি। পানি উন্নয়ন বোর্ড এই কাজ সম্পাদনের জন্য কয়েকবার অনুরোধ করেছে এই খনন পরিচালনায় ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের জন্য। এছাড়াও অধিগ্রহণকৃত জমির মধ্যে ব্যক্তিগত স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য একটি তালিকাও দিয়েছে। সাধারণ মানুষও প্রকল্প বন্ধের দাবি জানিয়ে স্মারকলিপি দিয়েছে। আমরা চাই উভয়পক্ষ বসে একটা সুষ্ঠু সমাধান। যাতে সরকারের এই উন্নয়নমূলক প্রকল্পও বাধাগ্রস্ত না হয় আর সাধারণ মানুষেরও ক্ষতি না হয়।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৩৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৪, ২০২৪
এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।