ঢাকা: ব্যস্ত সড়ক। সেই সড়কে সৃষ্টি হচ্ছে দফায় দফায় যানজট।
আর হাতুড়ি পেটার ফল ও পাচ্ছেন হাতেনাতে। যানজট লাগছে তো আবার ছাড়ছে। ব্যস্ত সড়কে তার হাতুড়ি পেটা থেকে বাদ পড়ছে না দো’তলা বাস থেকে শুরু করে রিকশা পর্যন্ত।
গাড়িতে হাতুড়ি পেটানোর শব্দে বেলাইনে থাকা গাড়িগুলো লাইনে যাচ্ছিলো। হাতুড়ি পেটার মুহূর্তটাও যেন কামারের হাতুড়ি পেটার শব্দের মতো।
হাতের পেশির মতো তার মুখের পেশিগুলোও যেন কুচকে যাচ্ছিলো হাতুড়ির পেটার সঙ্গে! ব্যস্ত সড়কে পুলিশের পোশাকে এভাবে হাতুড়ি হাতে দৌড়াতে দেখলে যে কেউই হয় পাগল ভাববেন। বিভ্রান্তও হতে পারেন। তবে তিনি পাগল নন। একেবারে সুস্থ সবল মানুষ। পদ পদবীর কারণে পুলিশ অফিসার বললেও বাড়িয়ে বলা হবে না এতটুকু-ও।
তিনি মনজুর হোসেন। আমর্ড পুলিশের উপ পরিদর্শক (এসআই)।
ব্যস্ততম ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভার বাজার বাসষ্ট্যান্ডে এভাবে হাতুড়ি হাতে যানজটের সঙ্গে প্রতিদিন লড়াইটা চলে তার। মঙ্গলবার (১৩ ডিসেম্বর) সরেজিমনে এমন দৃশ্য দেখা যায়।
তার এই ‘হাতুড়ি থেরাপির’ কারণে কতো গাড়ির ছাল ও কতো গাড়িতে ক্ষত চিহ্নের দাগ পড়েছে তার কোনো হিসেব নেই বলে বাংলানিউজকে জানান এসআই মজনুর হোসেন।
তিনি বলেন, ‘আগে লাঠি হাতে ডিউটি করতাম। দেখলাম, ভয় পান না চালকরা। কাউকেই কেয়ার করে না তারা। এখন হাতে হাতুড়ি দেখলেই অনেকে ভয় পায়। অনেকেই নিজের শরীরের চাইতে গাড়ির বডির প্রতি মায়া করেন বেশি। হাতুড়ি পেটালে যদি রং উঠে যায়। এই ভয়ে সবাই মাঝে চলেন। ব্যস। রাস্তাঘাট ক্লিয়ার। ফকফকে’।
ঘাম মুছে ফুরফুরা মেজাজে এমনটাই বলছিলেন আমর্ড এসআই মনজুর হোসেন।
হাতুড়ি থেরাপি আইডিয়াটা পেলেন কোত্থেকে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোথা থেকে আবার! নিজে নিজেই। দেখলাম অনেক মুর্খ চালক হাতের ইশারাকেও তোয়াক্কা করে না। বেপরোয়া ভাবে গাড়ি চালায়। পার্কও করে মর্জিমাফিক। একদিন ডিউটি করতে করতে ভেঙে গেলো হাতের লাঠিটা। মেজাজ মর্জিটাও অসহ্য ঠেকছিলো। তো রাস্তার পাশের একটি হার্ডওয়্যারের দোকান সাজিয়ে রাখা একটা হাতুড়ি তুলে নিলাম।
গাড়ির বডিতে দু’এক ঘা বসাতেই এর কার্যকারিতার প্রমাণ পেলাম। দেখলাম কাজ হচ্ছে। দু’একটি হাতুড়ির বাড়ি পড়তে না পড়তেই অবৈধ পার্কিং এরিয়া ছাড়তে শুরু করলো গাড়িগুলো। বেশ কাজেও দিলো এই হাতুড়ি থেরাপি। এভাবেই গড়গড় করে হাতুড়ির মাহাত্ম্য ঘোষণা করে যাচ্ছিলেন মনজুর হোসেন।
প্রথম হাতুড়ি প্রয়োগের স্মৃতির কথা তুলে ধরে মনজুর হোসেন বলেন, মহাসড়কে যখন অটোরিকশা নিষিদ্ধ হলো তখন দলবেঁধে চালকরা সড়কে ওঠার চেষ্টা করেছিলো। প্রথম মিটার বা সামনের বাতি হাতুড়ি দিয়ে ভেঙ্গে দেবার পর দেখলাম সব ঠান্ডা।
১৯৮৩ সালে কনষ্টেবল পদে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন মনজুর হোসেন। তারপর পদোন্নতি পেয়ে যথাক্রমে নায়েক থেকে হাবিলদার। বিভাগীয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এখন সেই স্পেশাল আর্মড ফোর্সের তিনি উপ পরিদর্শক।
মনজুর হোসেন বলেন, বেয়ারা চালকদের শায়েস্তা করার আইনগত কোনো ক্ষমতা নেই তার। চালকদের আইনভঙ্গের মতো অপরাধে ট্রাফিক সার্জেন্টদের মতো মামলা করার সুযোগ-ও নেই তাদের। তবে আমাদের আবার যানজটের সঙ্গে লড়াইটাও করতে হয় সমানতালে। সে হিসেবে হাতুড়িই বেশ।
ট্রাফিক পুলিশের সদস্য না হয়েও ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নানা বিড়ম্বনার পাশাপাশি এক্সট্রা কামাইয়ের প্রসঙ্গ আনতেই বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে তা নাকচ করে দেন তিনি।
বেতন পাই প্রায় ৪৫ হাজার টাকা, রেশন, টিএ ছাড়াও বাড়তি হিসেবে এসপি স্যারের কাছ থেকে প্রতি মাসে দু’হাজার টাকা মোবাইল বিল। এর বাইরে কি আর কিছু লাগে? উল্টো প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন তিনি।
তিনি গর্বের সঙ্গে বলেন, আমার বড় ছেলে মাহমুদুল হাসান রিফাত পুলিশে যোগদান করেছে। ছোট ছেলে নকিবুল হাসান অথৈ পড়ে চতুর্থ শ্রেণিতে। তাকে নিয়েই স্ত্রী থাকে গ্রামের বাড়ি গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বর্মি গ্রামে।
বেতন যা পাই তা দিয়েই আমাদের সংসার চলে। অন্য কিছু লাগেও না। সেদিকে চোখও পড়েনা।
মজনুর হোসেনের জীবনের আরও একটু গভীরে ঢুকতেই বেড়িয়ে আসে অজানা আরো অনেক গল্প।
সাভারে ধসে যাওয়া রানা প্লাজার পেছনে এক রুমের একটি বাসায় ভাড়া থাকেন তিনি। মাসে গুনতে হয় তিন হাজার টাকা। সকালে নাস্তা সারতে হয় হোটেলেই। ডিউটির সময় ভোর ছয়টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত। কোনো দিন আবার দ্বিতীয় পালায় বেলা ২টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত।
‘দুপুরে বাসায় গিয়ে নিজেই রান্না কিরি। রান্না কোথায় থেকে শিখলেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ছোট বেলায় আমাদের হোটেল ছিলো। সেখানেই বাবুর্চির কাছে তালিম। সেই থেকেই চলছে।
বাংলাদেশ সময়: ১১৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৬
বিএস