ঢাকা: মিরপুরের রায়েরবাজার বধ্যভূমি। এই বধ্যভূমি রচিত হয়েছিল বাঙালি জাতির বিবেক, মননশীলতা, চেতনা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি চিরতরে মুছে দিতে।
একাত্তরের সেই ভয়ানক দিন পেরিয়ে গেছে ৪৫ বছর। বাঙালি আজ বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। এই উঁচু করে দাঁড়াবার জন্য যে শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, চিকিৎসক, বুদ্ধিজীবীরা আত্মদান করেছেন, তাদের শ্রদ্ধা জানাতে ১৪ ডিসেম্বর (বুধবার) শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে জনতার ঢল নেমেছিল এই রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে।
মূল ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়লো সাইনবোর্ডে বড় করে লেখা, ‘মরণ সাগর পাড়ে তোমরা অমর’। সামনের বটবৃক্ষটি যেন এখনও সাক্ষ্য দিচ্ছে সেই ভয়ংকর কালরাতের।
সে বটবৃক্ষটির পাশে বসে তার কাছে যেন একাত্তরের গল্প শুনতে চাইছিল মাঝবয়সী কিশোর-কিশোরীরা। আলাপ করতেই তারা বললেন, “বইতে পড়েছি ১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবী হত্যা করে এখানে ফেলে রাখা হয়েছিল। আজকের দিনে তাদের স্মরণে এখানে আসা। ”ইটের তৈরি কয়েকটি সিঁড়ি পেরিয়ে একটু উপরে উঠতেই কানে এলো এক মায়ের গলা, তার সন্তানকে একাত্তরের ভয়ানক সাহসী গল্প বলছিলেন তিনি, “ওই দেখ, এখানেই হত্যা করা হয়েছিল অনেক মানুষকে। এখানে যাদের এনে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড় করানো হয়েছিল, তারা ভয় পাননি। অকপটে দিয়েছিলেন তাদের জীবন। ”
গল্প বলতে থাকা এই মায়ের নাম সামলা আক্তার। পরিত্যক্ত ইটভাটার উঁচু প্রাচীরটি দেখিয়ে ছোট মেয়ে সাইমাকে ভয়ঙ্কর-নৃশংস দিনের বর্ণনা করছিলেন তিনি।
উঁচু প্রাচীরের সেই স্থান থেকে একটু বাঁ দিকে এগোতে সামনে পড়লো মানুষের বড় জটলা। মাথাটা এগিয়ে চোখ দিতেই দেখা গেলো সেই নৃশংস হত্যাযজ্ঞের খণ্ড খণ্ড স্থিরচিত্র। বড় বড় করে সেখানে লেখা ‘৭১ এর কিলিং জোন’। সেইসব দৃশ্য একজন আরেকজনকে দেখাচ্ছিলেন, কেউ আবার একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে কাঁপছিলেন যেন শোক-আক্রোশে।
১০ বছর বয়সী লুমিয়া লুমা তার বাবার হাত ধরে শোক আর শ্রদ্ধা জানাতে এসেছে বধ্যভূমিতে। তার ভাষায় শোক ছিল এমন, “আব্বু-আম্মু বলেছে অনেক বুদ্ধিজীবীকে মেরে ফেলে রাখা হয়েছিল। তারা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন। তাই আব্বুর সঙ্গে এখানে এসেছি। ”শিক্ষক সুমন আকন্দও এসেছেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নির্মম হত্যাযজ্ঞের দিনে তাদের শ্রদ্ধা জানাতে। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, “রাজাকার-আলবদররা তাদের নৃংশসভাবে হত্যা করেছে। কিন্তু তারা তো মরেননি। তাই তো এত বছর পরেও আমরা তাদের স্মরণ করি। শুধু আমরা কেন, প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাদের স্মরণ করবে। ”
শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আসা সরকারি চাকুরীজীবী শামীম আহসান বলেন, “তাদের আদর্শ যেন জাতি ধারণ করে এবং সেই আদর্শে যেন প্রতিটি প্রজন্ম উজ্জীবিত হয় এই কামনা করছি। ”
বধ্যভূমির সামনের অংশের মতো প্রাচীরের পেছনের অংশেও দেখা যায় শ্রদ্ধা জানাতে আসা মানুষের ভিড়।
এখানে আসা প্রায় সব বয়সী মানুষের হাতে ছিল ফুল আর পতাকা। পুরোটা দিন বধ্যভূমিজুড়ে পতপত করে উড়ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয়ের পতাকা। কারও কারও গালে-হাতে দেখা যায় লাল-সবুজের পতাকার আল্পনাও। যেমন মেহের নামের একজন বললেন, “গালে বাংলাদেশের পতাকা আঁকিয়ে নিয়েছি। আমরা দেশকে অনেক ভালোবাসি। ”
বাংলাদেশ সময়: ০২০৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৬
জেডএফ/এইচএ/