সাভার (ঢাকা): রাজকীয় ভোজ ! পাতে আস্ত রূপচাঁদা ফ্রাই, কোরাল মাছের কারি, দেশি মুরগির রেজালা, পাঁচ মিশেলি সবজি । চিনিগুড়ো চালের সাদা ভাত।
মন্ত্রী সংসদ সদস্য, পুলিশ কর্তাসহ দেড় শতাধিক অতিথির পেট পূজোর এই রাজকীয় আয়োজনেই কচি মুরগির হাড্ডি চিবুলেন তারা। আবার এই দৃশ্য স্মরণীয় রাখতে মুঠো ফোনে বেশ কয়েকটি ছবিও তুলে রাখলেন নেতারা। কেউ কেউ আবার খাবার শুরুর আগেই সেলফি চর্চা করতেও কসুর করলেন না!
আশুলিয়ার অভিজাত রেস্তোঁরা ইনভেস্টরস ক্লাবে রোববার রাতের এ দৃশ্যেই দেখা গেলো মঞ্চ কাপাঁনো তৈরি পোশাক শ্রমিক সংগঠনের কতিপয় নেতা ও নেত্রীকে।
মজুরি বাড়ানোর দাবিতে গত সপ্তাহ জুড়েই অশান্ত রয়েছে আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল। শ্রমিকদের কর্মবিরতি ও বিক্ষোভের মুখে বৃহৎ ২০টির মতো তৈরি পোশাক কারখানা রোববারও কার্যত ছিলো অচল। যে কারণে থমকে যায় উৎপাদন ব্যবস্থা। মাথায় হাত পড়ে তৈরি পোশাক খাতের মালিকদের। এর প্রভাবে শিল্পাঞ্চলের অন্যান্য কারখানা জুড়ে তৈরি হয় নাজুক পরিস্থিতি।
বেলা গড়ার সাথে সাথে এ খবর চলে যায় সরকারের শীর্ষ মহলে। তখনই স্থানীয় সংসদ সদস্য ও তিন মন্ত্রীকে নির্দেশনা দেয়া হয় আশুলিয়া যাবার।
বাইপাইলে এলাহি কমিউনিটি সেন্টারেই চলে ‘এলাহি’ এই আয়োজনে বক্তৃতা সভার। এই প্রেক্ষাপটে শ্রমিক,মালিক,স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সাথে বৈঠক শেষে সাংবাদিক সম্মেলনে আসেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান, শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু, স্থানীয় সংসদ সদস্য ডা. এনামুর রহমানসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
পুলিশ সুপারের আয়োজনে ‘সাংবাদিক সম্মেলন’ নামের এই আয়োজনে বিকেলের পর থেকেই গোটা কমিউনিটি সেন্টারে আসতে শুরু করেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা কর্মী ছাড়াও ‘ভ্রাতৃপ্রতিম’ সংগঠনের নেতারা। মঞ্চে দেখা যায় ভুঁইফোড় বা হাইব্রিড গোছের কিছু সংগঠনের স্বঘোষিত নেতাকেও।
আবার মঞ্চের জায়গা দখল করে নেন আওয়ামী লীগের সাতটি সহযোগী সংগঠনের তালিকার বাইরের ‘লীগ’ যুক্ত করে থাকা বেশ কিছু শ্রমিক সংগঠনের নেতারাও।
সাংবাদিক সম্মেলন হলেও কে সাংবাদিক আর কে শ্রমিক সেই পরিচয় একাকার হয়ে যায় অনুষ্ঠানে।
প্রথমে শ্রমিক নেতারা মঞ্চ কাপাঁলেন। নেতারা কেউ বললেন, আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল শান্ত রাখার জন্যে তিনি নিজের গলা ভেঙ্গেছেন। কেউ বললেন,সবই ষড়যন্ত্র। কেউ বা আবার মনে করিয়ে দিলেন শ্রমিকদের কর্মবিরতি করাও আইনভাঙ্গা। কারণ শ্রম আইনে কি করে কোন দাবি দাওয়া তুলতে হয় তারও বয়ান দিলেন কেউ কেউ।
অধিকাংশ নেতাই বললেন অভিন্ন সুরে একটি কথা। ‘শ্রমিকদের জান,নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান’। এ স্লোগানে স্লোগানে তুমুল হাততালিতেও মুখর হলো কমিউনিটি সেন্টার। তারপর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। শেষে বক্তব্য নিয়ে আসলেন মন্ত্রীরা।
ঢাকার পুলিশ সুপার (এসপি) শাহ মিজান শাফিউর রহমানের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা ঘুরেফিরেই এই খাত নিয়ে তুলে ধরেন ষড়যন্ত্র ও অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারার কথা।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, উদ্দেশ্য নিয়ে যারা আশুলিয়ায় তৈরি পোশাক কারখানা নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে। শ্রমিকদের বিভ্রান্ত করছে। তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে। কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।
নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান বলেন,কতিপয় এনজিও আশুলিয়া শিল্প এলাকায় মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনের নামে শ্রমিকদের বিভ্রান্ত করছে। তৈরি পোশাক শিল্পে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে।
শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু বলেন,ষড়যন্ত্রে কান দিয়ে শিল্প ধংসের মতো কোন হঠকারিতায় পা ফেলার আগে শ্রমিকদের সতর্ক থাকতে হবে। তিনি বলেন,শ্রমিকদের কল্যাণে বহুমুখী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
কর্মস্থলে কোন তৈরি পোশাক কারখানায় শ্রমিক মারা গেলে তার পরিবারকে নগদ তিন লাখ টাকা ও বিমার ক্ষতিপূরণ বাবদ দুই লাখ টাকা প্রদান করা হবে।
বক্তারা কোন ষড়যন্ত্রে কান না দিয়ে সোমবার থেকে শ্রমিকদের কাজে ফিরে যাবার আহ্বান জানান। মাঝে অনুষ্ঠানের মুঠোফোনে অনুষ্ঠানের আবেশ পৌঁছে যায় প্রধানমন্ত্রীর কাছে।
আশুলিয়ার সর্বশেষ পরিস্থিতি তিনি জানতে চান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে। তখন গোটা কমিউনিটি সেন্টারজুড়ে পিনপতন নিরবতা।
তবে ‘সাংবাদিক সম্মেলন’ নামের আয়োজনে ছিলো না সাংবাদিকদের কোন প্রশ্নোত্তর পর্ব। তারপর নৌ পরিবহন মন্ত্রীর বক্তব্যের সাথে সাথেই হাট ভাঙ্গার মতো ভেঙ্গে যায় আয়োজন।
এরপর মন্ত্রীদের গাড়ির বহর চলে যায় ডিইপিজেড সংলগ্ন ইনভেস্টরস ক্লাবে। সেখানে মহাভোজে শ্রমিক নেতাদের অনেকেই শিল্পাঞ্চল শান্ত রাখায় নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করলেন।
রাজকীয় খাবার টেবিল অব্দি না পৌঁছুতে পেরে মঞ্চে থাকা শ্রমিক নেতাদের অনেককেই প্রকাশ্যে উষ্মা প্রকাশ করতে দেখা যায় ভোজে নিমজ্জিত নেতাদের নিয়ে।
কটাক্ষ আর মুণ্ডুপাত করেই যেন তারা ভুলে থাকার ব্যর্থ চেষ্টা করেন রাজভোজের স্বাদ না পাবার বঞ্চনা।
অনেকেই বলতেও ছাড়েননি, ‘উনারা তো ক্ষমতার পিছে পিছে লেপ্টে থাকেন। মন্ত্রীকে যারা শ্রমিকদের জান আখ্যা দেন তারাই তো খাবারের টেবিলে থাকবেন। আমরা ওমন কথা বলিও নি। ডাকও পাইনি। ’
ভোজ আয়োজনের ব্যাপারে কোন মন্তব্য করতে চাননি ইনভেস্টরস ক্লাব কর্তৃপক্ষ। তবে গেটের বাইরে দায়িত্বে থাকা আজব আলীই আজব তথ্য দেন।
বাংলানিউজকে তিনি জানান,আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মহসীনুল কাদির স্যারই এ আয়োজন করেছেন।
মাথাপিছু হাজার টাকা ব্যয়ের রাজকীয় এই মেন্যুর স্বাদ নিয়ে দাঁত খিলাল করতে করতে শ্রমিক নেতাদের অনেকে আবার খোদ রেস্তোরাঁতেই বিপ্লব নামিয়ে আনেন।
‘ষড়যন্ত্র বরদাস্ত করা হবে না। যারা ষড়যন্ত্র করছে তাদের চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থাও নেয়া হবে। ’ এমন সব কথা বলে তৃপ্তির ঢেকুর-ও তুললেন কেউ কেউ।
আশুলিয়া প্রেসক্লাবের নেতৃত্ব থাকা একজন গণমাধ্যম কর্মী আয়োজনের বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,সাংবাদিক সম্মেলন নাম দেয়া হলেও তাদের আসন গুলো রাখা হয়েছিলো এক পাশে। মঞ্চের আড়ালে। আর মঞ্চ থেকে বলা হলেও মঞ্চের বাইরের কেউ কোন প্রশ্ন করতে পারেনি। এমনকি সাংবাদিকরা অনেক বিষয়ে প্রশ্ন করার প্রস্তুতি নিলেও কেউ সে সুযোগটুকুও পায়নি।
সাংবাদিক সম্মেলনের নামে এ আয়োজনের বড় অংশ জুড়ে কতিপয় নেতা কেবলই বক্তৃতাবাজি করে গেলেন। আক্ষেপ করেন ওই সাংবাদিক।
কোন খাত থেকে এই রাজকীয় আয়োজন, এ ব্যাপারে কোন মন্তব্য করেননি আশুলিয়া থানার ওসি মহসীনুল কাদির।
আর্থিক খরচ কে যোগাবে? মেলেনি সেই প্রশ্নেরও কোন উত্তর।
এমন অস্বচ্ছ আয়োজন থেকে কতটা স্বচ্ছভাবে সংকটের অবসান হবে? এই প্রশ্নই এ মুখ থেকে ও মুখে ঘুরে ফিরেছে অনেকের।
বাংলাদেশ সময়: ১২৩৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১৬
আরআই