ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

প্রত্যাশা-প্রাপ্তির ২১ বছর পেরিয়ে পার্বত্য চুক্তি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০২৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২, ২০১৮
প্রত্যাশা-প্রাপ্তির ২১ বছর পেরিয়ে পার্বত্য চুক্তি ২১ বছর পেরিয়ে পার্বত্য চুক্তি

খাগড়াছড়ি: উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, শংকা, রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংঘাতের দীর্ঘ বছরের অস্থিতিশীল পরিবেশের বলয় থেকে প্রায় বেরিয়ে এসে পার্বত্য চট্টগ্রাম এখন আছে  শান্তি ও উন্নয়নের পথে। পাহাড়ে বদলে গেছে মানুষের জীবনযাত্রা। লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। ভয়ে আসতে না চাওয়া দেশ বিদেশের পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু এখন এ জনপদ। আর সব হয়েছে ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তির কারণে।

২ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির ২১ বছর পূর্তি। পদার্পন করছে ২২ বছরে।

দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা সশস্ত্র সংঘাতের অবসান ঘটিয়ে ১৯৯৭ সালের এই দিনে সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। মূলত জল বিদ্যুতের নামে কাপ্তাই বাঁধ তৈরি, রাজনৈতিকভাবে বাঙালি পুনর্বাসনসহ নানা কারণে পাহাড়ে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করেছিল জেএসএস। এরপর প্রায় দুই দশকের বেশি সময় ধরে চলে সশস্ত্র সংগ্রাম। এতে অসংখ্য মানুষ হতাহত হন। এরপর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চুক্তি সম্পাদিত হয়।
 
সরকারের পক্ষে চুক্তি স্বাক্ষর করেন তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অধিবাসীদের পক্ষে চুক্তি স্বাক্ষর করেন জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমা। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আনুষ্ঠনিকভাবে অস্ত্র সমর্পণ করেন সন্তু লারমাসহ ১ হাজার ৯শ’ ৬৮ জন শান্তি বাহিনীর সদস্য।

তবে পাহাড়িদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সরকার যে চুক্তি করেছে দীর্ঘ বছরে তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না দাবি করে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছে চুক্তি স্বাক্ষরকারী সংগঠন। তারা বলছে, চুক্তির মৌলিক ধারাগুলো এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। পরিপূর্ণভাবে চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় এখনও পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি আসেনি।
 
সম্প্রতি সন্তু লারমার পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি চুক্তি সম্পর্কিত তথ্য দিয়ে সংবাদ মাধ্যমে একটি বিবৃতি দেন। এতে বলা হয়, “চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে এবং মৌলিক বিষয়সমূহসহ দুই-তৃতীয়াংশ ধারা এখনো অবাস্তবায়িত। তিন পার্বত্য জেলার সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, পর্যটন, মাধ্যমিক শিক্ষা, উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়গুলো এখনো তিন পার্বত্য জেলাপরিষদে হস্তান্তর করা হয়নি। ক্ষমতাসীন দলের সদস্যদের নিয়োগ দিয়ে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের মাধ্যমে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদগুলো পরিচালনার ফলে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ দুর্নীতি, অনিয়ম ও গণ-বিরোধী আখড়ায় পরিণত হয়েছে। ”
 
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (সন্তু গ্রুপ) খাগড়াছড়ি শাখার সাধারণ সম্পাদক উদয়ন চাকমা বলেন, মৌলিক ধারাগুলো রেখে দিয়ে শুধু বাস্তবায়নের কথা বলা ঠিক না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ভূমি। ২০১৬ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের বিরোধপূর্ণ ধারা সংশোধন করা হয়। কিন্তু এরপর দুই বছরের অধিক সময় ধরে সরকার ভূমি কমিশনের বিধিমালা ঝুলিয়ে রেখে দিয়েছে। এই বিধিমালা চূড়ান্ত নাহওয়ার কারণে কমিশনের ভূমি বিরোধ সংক্রান্ত মামলার শুনানি বা বিচারিক কাজ শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না। চুক্তি বাস্তবায়ন বিলম্বিত হওয়ায় চুক্তি বিরোধী অপশক্তি পাহাড়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে বলেও জানান তিনি।

ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক) সভাপতি শ্যামল কান্তি চাকমা বলেন, আমরা শুরুতে পাহাড়ে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের কথা বললেও এখন মনে হচ্ছে পার্বত্য চুক্তির পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের আগে অন্যকিছু দাবি করা ঠিক হবে না। আর সরকার যেহেতু চুক্তি বাস্তবায়নে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না তাই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করে সরকারকে চুক্তি বাস্তবায়নে বাধ্য করা সময়ের দাবি। এদিকে জুম্ম জনগণের অধিকারের কথা বলে প্রসিত খীসার ইউপিডিএফ পাহাড়ে সশস্ত্র সংঘাত জিইয়ে রেখেছে। ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে মেতেছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন।
 
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সুধাকর ত্রিপুরা বলেন, সরকার যতটুকু না চুক্তি বাস্তবায়ন করছে তার চেয়ে বেশি বাস্তবায়নের কথা বলছে। আসল কথা হচ্ছে, চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে সরকারের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। না হলে চুক্তি বাস্তবায়নে ২১টি বছর লাগার কথা না। এদিকে চুক্তির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়ার পাশাপাশি স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় চুক্তি বিরোধী সংগঠন ইউপিডিএফ (প্রসিত গ্রুপ) বড় বাধা বলে তিনি জানান।
 
তবে ইউপিডিএফ (প্রসিত গ্রুপ) এর জেলা সংগঠক মাইকেল চাকমা বলেন, ‘আমরা শুরুতে বলেছি এই চুক্তি হলো জুম্ম গনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে নসাৎ করার অপকৌশল। এই চুক্তির মাধ্যমে সরকার জনগণকে ধোকা দিয়েছে। এদিকে খোদ চুক্তি স্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতি চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করেছে। এতেই বোঝা যায় এই চুক্তির বর্তমান অবস্থা।
 
ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে নিজেদের জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, কিছু ঘটলেই আমাদের ঘাড়ে দোষ চাপানো এ আর নতুন কি? আমরা জুম্ম জনগণের জন্য রাজনীতি করি। তারাই ভালো জানে কারা পাহাড়ে সংঘাত জিইয়ে রেখেছে।
 
এদিকে চুক্তি বাস্তবায়ন চলমান বলে জানিয়েছেন সরকার সমর্থকরা। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী বলেন, চুক্তির অধিকাংশ ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। বেশ কয়েকটি ধারা বাকি আছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে ভূমি। সেটি সমাধানের জন্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠন করা হয়েছে। আশা করি আগামীতে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে মধ্যবর্তী সময়ের মধ্যে চুক্তির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব।

পার্বত্যাঞ্চলের নানা শ্রেণী-পেশার মানুষের প্রত্যাশা—পাহাড়ে শান্তি স্থাপন ও চুক্তি বাস্তবায়নে সরকার দ্রুত উদ্যোগ নেবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৫২২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০২, ২০১৮
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।