আজকে এসে সেই ইতিহাস মনে রাখেনি কেউ। অনেকেই ভুলে গেছেন মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের সেই গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা।
স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের শিকার হয়েছিল রাজারবাগ পুলিশলাইন। এখান থেকেই প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধও শুরু হয়। সেই রাজারবাগের পুলিশ স্মৃতিস্তম্ভের পাশে দেড় বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত পুলিশ জাদুঘর।
অত্যন্ত নান্দনিক শিল্প-শৈলীতে নির্মিত এই জাদুঘরে ঢুকলে প্রথমেই দেখা যাবে বঙ্গবন্ধু গ্যালারি। গ্যালারির দু’পাশের দেয়ালে রয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নানা সময়ের দুর্লভ ছবি। পাশেই আছে মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা প্রায় দুই হাজার বইয়ের সমন্বয়ে একটি মনোরম লাইব্রেরি। যে কেউ লাইব্রেরিতে বসে এই বইগুলো পড়তে পারবেন। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের অবদান বিষয়ে লেখা বই এখান থেকে কিনতেও পারবেন।
বঙ্গবন্ধু গ্যালারির ঠিক মাঝ বরাবর একটি গোলাকার সিঁড়ি নেমে গেছে জাদুঘরের মূল কক্ষে। সেখানে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বিশাল সংগ্রহশালা। মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্ন, মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ব্যবহার করা বিভিন্ন অস্ত্র এবং পোশাক, এমনকি বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ব্যবহার করা .৩৮ বোর রিভলভারটিও আছে এই জাদুঘরে।
জাদুঘরের মূল কক্ষে প্রবেশ করলেই শোনা যায় মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বিভিন্ন দেশাত্মবোধক গান। এছাড়াও রয়েছে একটি অডিও ভিজুয়াল গ্যালারি। যেখানে আছে দর্শনার্থীদের জন্য ২৫ মার্চের কালরাতে প্রথম প্রতিরোধের ওপর নির্মিত ৪০ মিনিটের একটি ডকুমেন্টারি দেখার ব্যবস্থা।
২৫ মার্চের সেই কালরাতে রাজারবাগ পুলিশলাইন আক্রমণের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধে ব্যবহৃত থ্রি নট থ্রি রাইফেল, শহীদ পুলিশ সদস্যদের ব্যবহৃত পোশাক, চশমা, টুপি, বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণার টেলিগ্রাম লেটার এখানে সংরক্ষণে রয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম আইজিপি আবদুল খালেকের ব্যবহৃত চেয়ার, যুদ্ধের সময় উদ্ধার করা গুলি, ব্যবহৃত হ্যান্ডমাইক এবং দূর থেকে শত্রুর অবস্থান দেখার জন্য পুলিশ বাহিনীর সার্চলাইটও স্থান পেয়েছে এখানে।
রাজারবাগ পুলিশলাইনের টেলিকম ভবনের দেয়াল ঘড়ি, যুদ্ধকালীন পুলিশ সদস্যদের বিভিন্ন চিঠিপত্র, ২৫ মার্চ রাতে যে বেতার যন্ত্রের মাধ্যমে সারাদেশে পুলিশ সদস্যদের রাজারবাগ আক্রমণের খবর দেওয়া হয়েছিল, সেই হেলিকপ্টার ব্যাজ বেতার যন্ত্র, ওয়্যারলেস সেট, প্রথম প্রতিরোধের রাতে যে পাগলা ঘণ্টা বাজিয়ে পুলিশ সদস্যদের একত্রিত করা হয়েছিল, সেই পাগলা ঘণ্টাটিও আছে জাদুঘরে।
জাদুঘরে আরও আছে মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ব্যবহার করা ৭.৬২ এমএম রাইফেল, রিভলভার, মর্টার শেল, ৩০৩ এলএমজি, মেশিনগান, ৭.৬২ এমএম, এলএমজি .৩২ বোর রিভলভার, .৩৮ বোর রিভলভার, ১২ বোর শটগান, ৯ এমএম এমএমজিসহ অন্যান্য অস্ত্র।
জাদুঘরে দেখা পাওয়া যায়, মুঘল, ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের পুলিশের ইউনিফর্ম, পুলিশের তরবারি, চাবুক, টহল পুলিশের ব্যবহৃত শিঙ্গা, পাকসেনাদের দ্বারা নির্যাতিত নারীর চিঠিতে ২৫ মার্চের বর্ণনা, নির্যাতিত নারীর পিতার লেখা চিঠি, যে বেঞ্চে শুইয়ে আহত পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল, যুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত সেই কাঠের বেঞ্চ, গেরিলা প্রশিক্ষণে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের আলোকচিত্রসহ অন্যান্য জিনিসপত্র।
রাজধানীর শাহজাহানপুর থেকে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র তৌশিক ফয়সাল রিয়াদ এসেছিল পুলিশ জাদুঘর দেখতে। তখন বাংলানিউজকে সে বলে, আমার দাদা শামসুর রহমান একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। বাবার কাছে মুক্তিযুদ্ধের অনেক গল্প শুনেছে। তাই এই মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর দেখতে এসেছি।
কৌশিক বলে, পাকিস্তান আগে আমাদের ওপর হামলা করেছে। তাই আমরাও হামলা করেছি। এভাবেই দেশ স্বাধীন হয়েছি। পাকিস্তানিরা খুব খারাপ। তারা আমাদের অনেক মানুষ খুন করেছে।
পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের পরিচালক এসপি আবিদা সুলতানা বাংলানিউজকে বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি পুলিশ সদস্যদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকাকে নতুন প্রজন্ম এবং বিশ্ববাসীর মধ্যে ছড়িয়ে দিতে, যুদ্ধে পুলিশের স্মৃতি চিহ্নকে ধরে রাখতে এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস এবং পুলিশ সদস্যদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়নের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।
দর্শনার্থীদের জন্য গ্রীষ্মকালে (মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর) সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৬টা এবং শীতকালে (অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি) সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত জাদুঘরটি খোলা থাকে। বুধবার এর সাপ্তাহিক বন্ধ। এছাড়া শুক্রবার বিকেল ৩টা থেকে ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে জাদুঘরটি। এর প্রবেশ মূল্য ১০ টাকা। তবে ডিসেম্বরে শিক্ষার্থীদের জন্য এবং সব জাতীয় দিবসে সবার জন্য বিনামূল্যে এই জাদুঘর দেখার ব্যবস্থা রয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০১৯
আরকেআর/টিএ