ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

মসজিদভিত্তিক একই ধাঁচের প্রকল্প ৬ বার, চলছে ২৭ বছর ধরে!

মফিজুল সাদিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৭, ২০২০
মসজিদভিত্তিক একই ধাঁচের প্রকল্প ৬ বার, চলছে ২৭ বছর ধরে!

ঢাকা: সরকারের উন্নয়ন বাজেটের আওতায় বিনিয়োগধর্মী একটি বিশেষ কাজ নির্দিষ্ট মেয়াদে সম্পন্ন করার জন্য প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। নতুন নিয়ম হয়েছে চার বারের বেশি কোনো প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করা যাবে না। অথচ ‘মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কাযর্ক্রম’ একই ধরনের প্রকল্প ছয় বার নেয়া হয়েছে।

নতুন করে সপ্তম পর্যায়ে প্রকল্প নেয়ার আবেদন করেছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। ৭ম পর্যায়ে প্রকল্প নেয়ার জন্য নানা ধরণের যুক্তি তুলে ধরেছে সংস্থাটি ।

তবে বেঁকে বসেছে পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) ও অর্থ বিভাগ। একই ধরনের প্রকল্প বার বার হাতে না নিয়ে একে রাজস্বের আওতায় আনার সুপারিশ করেছে অর্থবিভাগ ও আইএমইডি।
 
নতুন করে সপ্তমবারের মতো একই ধরনের প্রকল্প নেয়ার প্রস্তাব গেছে পরিকল্পনা কমিশন। আইএমইডি জানায়, সপ্তম পর্যায়ে প্রকল্পের জনবল বেতন, সম্মানী দেয়ার বিষয়ে স্টিয়ারিং কমিটির কোনো এখতিয়ার নেই। এই জন্য দরকার প্রকল্পের কাযর্ক্রম রাজস্ব বাজেটের আওতায় পরিচালনা করা।

অন্যদিকে অর্থবিভাগ জানায়, ২৭ বছর ধরে কোনো প্রকল্প চলতে পারে না। নতুন করে এই প্রকল্পের আওতায় অর্থ বরাদ্দ দেয়াটাও তাই অযৌক্তিক। একে প্রকল্প না ভেবে ভিন্ন দৃষ্টিতে ভাবতে হবে।
 
অর্থবিভাগের যুগ্ম সচিব আব্দুর রহমান খান বাংলানিউজকে বলেন, কোনো প্রকল্প ২৭ বছর ধরে চলতে পারে না। এটা কোনো গ্রামারের মধ্যেও পড়ে না। প্রকল্প সব সময় নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হতে হবে। নানা চাহিদার ভিত্তিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, তবে এটা নিয়ে ভিন্নভাবে পরিকল্পনা করা যেতে পারে।

অন্যদিকে পরিকল্পনা কমিশন জানায়, প্রকল্পের প্রস্তাবিত সপ্তম পর্যায়ে ছাত্র ছাত্রীদের বই দেয়ার জন্য মুদ্রণ খাত হতে ইতোমধেই অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে যেহেতু শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ প্রকল্পের নিয়মিত জনবল নন, সেহেতু তারা শিক্ষা কাযর্ক্রম চলমান রাখতে পারেন।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন সূত্র জানায়, প্রকল্পটি সরকারের বিশেষ বিবেচনায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পটি যথাসময়ে সম্পন্ন হবে। এ প্রেক্ষাপটে ৭ম পর্ায়ে প্রকল্প অনুমোদনের পূর্ব পযর্ন্ত প্রকল্পের প্রধান কার্যালয়সহ জেলা ও উপজেলা শিক্ষাকেন্দ্র, দারুল আরকাম মাদ্রাসা এবং রিসোর্স সেন্টারের কাযর্ক্রম চলমান রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।

প্রকল্পটি জননন্দিত বৃহৎ প্রকল্প। এ প্রকল্পের আওতায় দেশের ৬৪টি জেলা, ৫০৫টি উপজেলা, থানা ও জোনে চলমান। ৩২ হাজার প্রাক-প্রাথমিক, ৪১ হাজার কুরআন শিক্ষা এবং ৭৬৮টি বয়স্ক কেন্দ্রেসহ মোট ৭৩ হাজার ৭৬৮টি শিক্ষা কেন্দ্রের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। প্রকল্পটি ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্তির জন্য নির্ধারিত ছিল। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্পটি ৭ম বারের মতো প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পের সকল কেন্দ্র চালু রাখাসহ প্রকল্পের আওতায় নিয়োজিত জনবলের বেতন, সম্মানী ও ভাতা পরিশোধের প্রস্তাব করা হয়েছে। সার্বিক দিক বিবেচনা করে প্রকল্পটি ৭ম পর্যায়ে অনুমোদন পাবে বলে আশা করছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সচিব কাজী নূরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, আশা করছি সপ্তম পর্যায়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। প্রকল্পের সঙ্গে পাবলিক সেন্টিমেন্ট বা জনগণের অনুভূতি জড়িত। ইচ্ছা করলেই প্রকল্প বন্ধ করা যাবে না। সকল বিষয় আমরা সমাধান করেছি, ৭ম পর্যায়ে হতে আর বাধা নেই। বর্তমানে শিক্ষকদের মাসে সাড়ে ৪ হাজার টাকা বেতন দেয়া হচ্ছে। সামনে তা বাড়িয়ে সাড়ে ৫ হাজার টাকা করা হবে।

রাজস্ব আওতায় আনার পরিকল্পনা প্রসঙ্গে সচিব বলেন, এই বিষয়েও আলোচনা চলছে।

ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রকল্প ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বৃহৎ প্রকল্প। আর্থ সামাজিক উন্নয়নমূলক কার্যক্রম ও শিক্ষা বিস্তারের কাজে মসজিদের ইমাম সাহেবদের সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে সরকার ১৯৯৩ সালে মসজিদ ভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় প্রাক-প্রাথমিক এবং ঝরেপড়া (ড্রপ-আউট) কিশোর-কিশোরী ও অক্ষরজ্ঞানহীন বয়স্কদের জন্য মসজিদভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে। এ প্রকল্পের আওতায় এ কার্যক্রমের ইতোমধ্যে ৬টি পর্যায় শেষ করে এটিকে ৭ম পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ প্রকল্পে মসজিদের ইমামগণ মসজিদকেন্দ্রে শিশু ও বয়স্ক শিক্ষার্থীদেরকে বাংলা, অংক, ইংরেজি, আরবি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধসহ বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দান করছেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সুবিধাবঞ্চিত স্থানে এ প্রকল্পের মাধ্যমে দেশে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তার ও র্কোস সম্পন্নকারীদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার বৃদ্ধির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হচ্ছে। এ প্রকল্পের সুবিধাভোগী অধিকাংশই সমাজের অবহেলিত, দরিদ্র ও নিরক্ষর জনগোষ্ঠি।

এ শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় প্রতিটি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্রে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০ জন, সহজ কুরআন শিক্ষাকেন্দ্রে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৫ জন ও বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্রের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৫জন। ধারাবাহিকভাবে চলমান এ প্রকল্পটির আওতায় ১ম পর্যায়ে মোট ৯৪ হাজার ৫৯০জন, দ্বিতীয় পর্যায়ে মোট ৭ লক্ষ ২৩ হাজার ৮৮০ জন, ৩য় পর্যায়ে মোট ১৬ লক্ষ ৪৩ হাজার ৪০ জন শিক্ষার্থীকে শিক্ষাদান করা হয়। একই ধারাবাহিকতায় ৪র্থ পর্যায়ে প্রকল্পের মাধ্যমে ২৯ লক্ষ ৩৭ হাজার ৬০০ জন শিক্ষার্থীকে প্রাক-প্র্রাথমিক ও পবিত্র কুরআন শিক্ষা প্রদান করা হয়। ৫ম পর্যায়ে জানুয়ারী ২০০৯ থেকে ডিসেম্বর ২০১৪ সাল পর্যন্ত মোট ৬৫ লক্ষ ৩৫ হাজার ২০০ জন শিক্ষার্থীকে শিক্ষাদান করা হয়েছে,যার অগ্রগতি শতভাগ।

এ  হিসেবে প্রকল্প কার্যক্রম খরচ অর্থাৎ প্রথম পর্যায় ১৯৯৩ সাল অর্থাৎ প্রকল্পের ১ম পর্যায় থেকে ৫ম পর্যায়ের ২০১৪ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত প্রাক-প্রাথমিক, সহজ কুরআন শিক্ষা ও বয়স্ক শিক্ষাস্তরসহ মোট ১ কোটি ১৮ লক্ষ ৯৩ হাজার ৯৫০ জনকে শিক্ষা দান করা হয়েছে।

আগ্রহী আলেমদের জন্য দ্বিনী দাওয়াতভিত্তিক কর্মসংস্থান এবং সাক্ষরতা হার আরো বৃদ্ধির লক্ষ্যে ৩০ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে একনেকে ১ হাজার ৫শত ৯৩ কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্দ রেখে ২০১৫ হতে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৫ বছর মেয়াদে ‘মসজিদভিত্তিক শিশু গণশিক্ষা কার্যক্রম’ শীর্ষক  ৬ষ্ঠ পর্যায় প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়।
 
অনুমোদিত প্রকল্পটির মাধ্যমে সারাদেশব্যাপী ৩২ হাজারটি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র ৪৪ লক্ষ ১০ হাজার জন শিশু শিক্ষার্থীকে অক্ষর জ্ঞানদানসহ নৈতিকতা শিক্ষা দিয়ে আসছে। ৭৬৮টি বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্রের মাধ্যমে সারাদেশে ৯৬ হাজার জন বয়স্ক (পুরুষ, মহিলা এবং জেলখানার কয়েদি) নিরক্ষরকে সাক্ষর করার পাশাপাশি ধর্মীয়  শিক্ষা দেয়া হচ্ছে।

৪১ হাজারটি সহজ কুরআন শিক্ষা কেন্দ্রের মাধ্যমে ৫১ লক্ষ ১০ হাজার জন স্কুলগামী শিক্ষার্থী ও ঝরেপড়া কিশোর-কিশোরীদেরকে স্বাক্ষর জ্ঞানদানসহ শুদ্ধভাবে পবিত্র কুরআন শরীফ শিক্ষা ও বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনতা শিক্ষা দেয়া হচ্ছে।  ৩টি শিক্ষা স্তরে ৫ বছর মেয়াদে সর্বমোট ৯৬ লক্ষ ১৬ হাজার জনকে শিক্ষা দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।

প্রকল্পের মোট ব্যয়  ২ হাজার ২৭২ কোটি ৪ লাখ টাকা। প্রকল্পের শুরু থেকে ২০১৯ সালের নভেম্বরে পযর্ন্ত আর্থিক অগ্রগতি ২ হাজার ৭৩ কোটি ৬৮ লাখ, যা মোট প্রকল্প ব্যয়ের ৯১ দশমিক ২৭ শতাংশ এবং বাস্তব অগ্রগতি ৯৭ শতাংশ।  

বাংলাদেশ সময়: ০৮১৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০২০
এমআইএস/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।