সরিষা ফুলে ঘুরে বেড়ানো মধু পিয়াসী মৌমাছির গুণগুণ-গুঞ্জরণে সৃষ্ট আবহ মাতিয়ে তোলে হাজারও প্রকৃতিপ্রেমীদের। এমন আবেশে কে না হারিয়ে যেতে চায়! প্রিয় মানুষটিকে প্রকৃতির এমন আবহে প্রতিস্থাপন করে স্বপ্ন বুনতে চায় প্রেমিক মন।
এমন মোহেই হয়তো পল্লীকবি জসিম উদ্দিন লিখেছিলেন,
“ আরো একটুকো এগিয়ে গেলেই সরষে ক্ষেতের পরে,
তোমারে আমার যত ভাল লাগে,
সে অনুরাগে হলুদ বসন
বিছাইয়া আছে দিক দিগন্ত ভরে।
দুধারে অথৈ সরিষার বন
মাঝখান দিয়ে সরু বাঁকা পথখানি।
দোষ নিওনাক ফুলেরা তোমার
ধরিলে আঁচল টানি। ”
চলনবিল অধ্যুষিত সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার কুন্দইল, মাকড়শোন, কামারশোন, সগুনা, মাগুড়া বিনোদ গ্রামের মাঠগুলো ছেয়ে গেছে হলুদ সরিষায়। আর দিগন্তজোড়া বিস্তীর্ণ সরিষা ক্ষেতের মধ্যে নিজেকে বার বার হারিয়ে যেন খুঁজে ফিরছে তরুণ-তরুণীর দল। ছুটি কিংবা অবসর সময়ে শত শত প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ ছুটেছে এ অঞ্চলে। আর এমন সুন্দর দৃশ্য ধারণ করতে চলছে আইফোনে সেলফি তোলার প্রতিযোগিতা।
নাটোর জেলার গুরুদাসপুর থেকে মামার সঙ্গে সরিষার ফুল দেখতে এসেছে শিশু সিয়াম। মোবাইলে নিজের সেলফি তুলছিল সে। সরিষা ক্ষেতের চিত্র ধারণ করছিলেন তাড়াশ ডিগ্রি কলেজের ছাত্রী মনিরা খাতুন, ইসমা খাতুন ও আতিয়া বেগম। নাটোরের চাঁচকৈড় বাজার থেকে এসেছিলেন পৌর কর্মচারী প্রিন্স, বেসরকারি চাকরিজীবী তারেক ও ব্যাংকার তৈয়বুর রহমান।
সরিষা ফুল দেখতে আসা এসব পর্যটকেরা বলেন, ঋতু বৈচিত্র্যের এই দেশে চলনবিল বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপে সজ্জিত হয়। কখনো দিগন্তজোড়া সবুজ মাঠ, কখনো বিলভরা পানিতে সারি সারি পাল তোলা ডিঙ্গি নৌকা আবার কখনো সরিষা ফুলে ছেয়ে যায় প্রান্তর। প্রকৃতির এমন পরিবর্তিত রূপ সব প্রকৃতিপ্রেমীরই ভাল লাগে। তাই সব ঋতুতেই দর্শনার্থীরা চলনবিলে আসেন।
সরিষা ফুলের সৌন্দর্য়ের টানে এখানে আসতে মন চায় উল্লেখ করে সাগরিকা আক্তার নামে এক কলেজছাত্রী বলেন, প্রতিবছরই শীতকাল এলেই প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার বান্ধবীদের সঙ্গে নিয়ে এই বিল দেখতে আসি।
প্রথমবারের মতো এমন হলুদের সমুদ্র দেখতে আসা শিশু সিয়াম বলে, মামার সঙ্গে সকালে এসেছি। এমন সুন্দর দৃশ্য ছেড়ে যেতেই মন চায় না।
রজব আলী, আজিজুর রহমান সবুজ, মীর তৌফিক আহম্মেদ, সোহরাব হোসেন, দুলাল হোসেন, হায়দার আলীসহ সরিষা চাষিরা বলেন, সরিষার আবাদ চলনবিলের একটি ঐতিহ্য। প্রায় সব কৃষকই একযোগে সরিষার আবাদ শুরু করেন। প্রতি কৃষক ১০ থেকে ৪০ বিঘা পর্যন্ত জমিতে সরিষা আবাদ করেন। একযোগে সরিষা বোনার কারণে একসঙ্গে চারা বড় হওয়ার পাশাপাশি ফুলও আসে। ফলে সরিষা মাঠ হলুদে ছেয়ে যায়।
সরিষা ক্ষেতে পর্যটকদের ভিড় প্রসঙ্গে কৃষকেরা বলেন, অনেকেই ক্ষেতের মাঝখানে ঢুকে যায়। এতে কিছু সরিষা নষ্টও হয়। তারপরও আমরা কাউকে বাধা দেই না। কারণ এটা এলাকার ঐতিহ্য। লোকজন দেখতে আসলেই আমাদের ভাল লাগে।
সগুনা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহেল বাকী জানান, চলবিলের এই সরিষার মাঠ দেখার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসেন, ছবি তোলেন। বিশেষ করে শুক্রবারে দর্শনার্থীরা সপরিবারে আসেন। সরিষা ক্ষেতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তারা ছবি তোলেন। এতে কিছু সরিষা নষ্টও হয়ে যায়। তারপরও কোনো কৃষক তাদের বাধা দেন না। বিভিন্ন স্থানের দর্শনার্থী দেখে এখানকার কৃষকেরাও নিজেদের গর্বিত মনে করেন।
সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ, উল্লাপাড়া, শাহজাদপুর ও রায়গঞ্জ, পাবনা জেলার চাটমোহর, ফরিদপুর ও ভাঙ্গুড়া, নাটোর জেলার সিংড়া ও গুরুদাসপুর এবং নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিয়ে চলনবিল। এ বিলে ১৬টি ছোটবড় নদী ও ২২টি খাল রয়েছে। ফসলি জমির পরিমাণ ১ লাখ ৬৬ হাজার ৫৩৫ হেক্টর। এ এলাকার হাজার হাজার কৃষকের জীবন-জীবিকা চলনবিলের বিস্তৃত কৃষি জমির উপর নির্ভরশীল। এ বিলে উৎপন্ন ধান, সরিষা এবং বর্ষাকালে মাছ ধরেই এখানকার অধিকাংশ মানুষ তাদের জীবিকা নির্বাহ করেন।
সিরাজগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. হাবিবুল হক বলেন, এ বছর সরিষার বাম্পার ফলন হয়েছে। জেলায় ৫২ হাজার ৬৮০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ করা হচ্ছে। এর অধিকাংশই চাষ হয়েছে চলনবিল অঞ্চলে। গত বছরের চেয়ে এবার ২ হাজার ১০৫ হেক্টর বেশি জমিতে এ আবাদ করছে কৃষক। এ বছর সরিষার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় সোয়া লাখ মেট্টিক টন।
বাংলাদেশ সময়: ১১১৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২১, ২০২০
আরএ