তরুণী মৌসুমীর বয়স ১৮ পেরোলেও দেখে বুঝা মুশকিল। শারীরিকভাবে বেড়ে ওঠেননি তিনি।
গ্রামের ১৪ বছরের কিশোরী আছিয়া জন্মগতভাবেই ডান হাত-পা বিকলঙ্গ। তিন বোন দু’ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় সে। বাবা ছওয়াব আলীর মৃত্যুর পর তার মা অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করে সংসার চালান। কিছুদিন মাদ্রাসায় গেলেও শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তাকে অচল করে দিয়েছে।
মৌসুমী ও আছিয়ার মতো গ্রামের প্রতিটি ঘরে ঘরেই রয়েছেন শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী। যাদের বেশিরভাগই জন্মগতভাবে প্রতিবন্ধী। গ্রামের হাজেরা বেগম, সামিয়া, ছাবেরা, সাফিয়া, সুমানা, ইয়ামিম, তামিম আহমদ, মাসুদ, রেদওয়ান, তাহমিদ, সাহেলসহ প্রায় চার শতাধিক প্রতিবন্ধী রয়েছে এই গ্রামে। যে কারণে গ্রামটির নামই উপজেলার লোকজনের কাছে প্রতিবন্ধী গ্রাম। সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার রামপাশা ইউনিয়নের আমতৈল গ্রাম এটি। গ্রামটি সিলেট জেলায় পড়লেও সুনামগঞ্জ জেলার সীমান্ত ঘেঁষা। কেবল এই গ্রামেই নয়, ইউনিয়নের চারটি ওয়ার্ডের গ্রামের অবস্থাই এমন।
স্থানীয়রা বলেন, জন্মের পর থেকেই তাদের সন্তানরা শারীরিক প্রতিবন্ধী হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছে। একটু বড় হলে হাঁটাচলা করতে পারছে না। আর অভাবের তাড়নায় এলাকার লোকজন চিকিৎসাসেবা থেকেও বঞ্চিত রয়েছেন। ফলে এক বা দুইজন নয়। গ্রামে রয়েছেন চার শতাধিক প্রতিবন্ধী! কিন্তু এই সংখ্যা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইউনিয়নের ১, ২, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের একটি গ্রামের অন্তর্গত জমসের পুর, কোনাউরা, মাঝপাড়া, ধলীপাড়া, আমতৈল, মাখরগাঁও, ফকিটিল্লা, শেখপাড়া, দক্ষিণপাড়া ও চার নম্বর ওয়ার্ডের কাতলীপাড়া গ্রামগুলোতে ঘরে ঘরে প্রতিবন্ধী। গ্রামের এমন অবস্থা যেনো, চিকিৎসাসেবা এখানে এসে পৌঁছায়নি। সিলেট জেলার অন্য সব উপজেলা মিলিয়ে এই গ্রামের প্রতিবন্ধীর সংখ্যার দ্বারে কাছেও হবে না।
এদিকে গ্রামে ৯৯ শতাংশ মানুষ অস্বচ্ছল হওয়াতে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। আর প্রতিবন্ধীর সংখ্যা বেশি হওয়াতে সরকারি সহায়তাও তেমনটি ঝুটে না বললেন গ্রামের অনেকে।
সরকারি সহায়তা পাওয়ার বিষয়ে গ্রামের আলিমুন নেছা বলেন, ভাতার টাকা সামান্য। তাতে নয়জনের পরিবার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন।
গিয়াস উদ্দিন বলেন, ভাতা পর্যাপ্ত পাই না। আর এক পরিবারে একের অধিক নাম ভাতায় ঢোকানো মুশকিল হয়ে যায়।
বিশ্বনাথ উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল জুবায়ের বলেন, কোনো পরিবারে শতভাগ প্রতিবন্ধী ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর নতুন উদ্যোগ দেশের শতভাগ প্রতিবন্ধীদের ভাতার আওতায় আনা হবে। সেটি বাস্তবায়ন হলে পরিবারের একাধিক প্রতিবন্ধীও ভাতা পাবে।
রামপাশা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আলমগীর হোসেন বাংলানিউজের কাছে গ্রামের এমন দুরবস্থা তুলে ধরে বলেন, গ্রামের ৯৯ শতাংশ মানুষ পেশায় মৎস্যজীবী। গ্রামের লোকসংখ্যাও খুব বেশি। ঘনবসতিপূর্ণ গ্রামের সবগুলো পাড়া মিলিয়ে লোকসংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার হবে। গ্রামে প্রতিবন্ধীর সংখ্যা প্রায় চার শতাধিক। নতুনভাবে জন্ম নেওয়া শিশুরাও প্রতিবন্ধী হিসেবে জন্মাচ্ছে। বিষয়টি সত্যিই হতাশাজনক।
আলমগীর হোসেন আরও বলেন, হতদরিদ্র হওয়াতে এলাকার লোকজন বিয়েসাদি সব নিজেদের মধ্যেই সারেন। যে কারণে প্রতিবন্ধী হওয়ার পেছনে বংশপরম্পরা (জেনেটিক) সমস্যা হিসেবে দেখছেন তিনি।
এ বিষয়ে সিলেটের সিভিল সার্জন প্রেমানন্দ মণ্ডল বাংলানিউজকে বলেন, বংশে প্রতিবন্ধী হয়ে জন্মানোর একটি বৈজ্ঞানিক কারণও থাকতে পারে, বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে। এজন্য উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি করা প্রয়োজন। কেবল চিকিৎসা নয়, গ্রামটিকে এই অবস্থা থেকে উত্তরণে মাল্টি সেক্টরের পদক্ষেপ জরুরি। কেননা, এলাকার লোকজনের মধ্যে শিক্ষার হার না থাকায় স্বাস্থ্য সচেতনতা নেই। যে কারণে পুষ্টিহীনতাসহ জন্মগত ত্রুটির কারণে শিশুরা প্রতিবন্ধী হচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯১৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০২০
এনইউ/এএটি