আড়িয়াল খাঁ ও কালাদবদর নদী ও ভোলানাথ গ্রাম দিয়ে ঘেরা ছোট্ট নলচর গ্রামে প্রায় ৬ হাজার মানুষের বসবাস। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৮ বছর পর এই প্রথমবারের বিদ্যুৎ যাচ্ছে এ গ্রামে।
আসন্ন দিনগুলোর কথা ভেবে আনন্দিত গ্রামের শিশু থেকে শুরু করে নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ সবাই। ৭০ শতাংশ সোলার বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল এ গ্রামের মানুষের সরাসরি বিদ্যুত সংযোগ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল বহুদিনের। এতে করে নলচর গ্রামের ভাগ্য পরিবর্তন আসবে। শিক্ষা, চিকিৎসা, চাষাবাদ ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব ক্ষেত্রে বিপ্লব আসবে বলে আশা করছে তারা।
গ্রামের বাসিন্দা জেলে সেরাজ খাঁ জানান, নলচরের মানুষ এতোটাই বিচ্ছিন্ন যে, মাধ্যমিক স্তরের পড়াশোনা করতে হলে আধঘণ্টা সময় ব্যয় করে আড়িয়াল খাঁ নদ পার হয়ে তাদের যেতে হয় দূরের বুখাইনগরে। বিদ্যুতের অভাবে এখানে অবকাঠামোগত কোনো উন্নয়ন ঘটেনি। একই কারণে এ গ্রামে কোনো শিক্ষক বা চিকিৎসকও থাকতে চান না। এমনকি জনপ্রতিনিধিরাও থাকেন না এখানে। চিকিৎসার জন্য মুমূর্ষু রোগীদেরও ট্রলারে চেপে যেতে হয় প্রথমে সেই বুখাইনগরে। সেখান থেকে সড়কযোগে বেলতলা খেয়াঘাট, তারপর খেয়া পার হয়ে বরিশাল শহরের কোনো হাসপাতালে। এর মাঝে অনেক রোগীই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
তিনি জানান, শুধু শিক্ষা-চিকিৎসাই নয়, এই গ্রামে কোনো ভালো মানের দোকানপাট বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও নেই যেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য পাওয়া যায়। সড়কপথের উন্নয়ন না হওয়ায় এখনও গোটা গ্রামই চষে বেড়াতে হয় পায়ে হেঁটে। বিদ্যুতের অভাবে রাতের অন্ধকারে পথ হাঁটতে হয় হারিকেন বা টর্চ লাইটের আলোয়।
সরাসরি বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকলেও এ গ্রামের অনেক বাড়িতেই সোলার বিদ্যুতের ব্যবস্থা আছে, কিন্তু তাতে যথাযথ প্রয়োজন মেটে না। এ ব্যাপারে বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, বিদ্যুৎ আসলে আর কিছু হোক বা না হোক নলচরের মানুষ প্রযুক্তি ও আধুনিক বাংলাদেশের সাথে যুক্ত হতে পারবে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর এই এলাকার মানুষের আর্থিক উন্নয়নও ঘটবে। সোলার বিদ্যুতের কারণে পুরো গ্রামে একটাও টেলিভিশন নেই, বিদ্যুতের অভাবে মোবাইল টাওয়ার না থাকায় নেটওয়ার্কের সমস্যায় পড়তে হয় প্রতিনিয়ত।
‘সব থেকে বড় বিষয় যানবাহনবিহীন এই গ্রামে কেউ কোনো কাজে কোনো মটর ব্যবহার করতে পারে না। কিন্তু সরাসরি বিদ্যুৎ আসলে সব কাজে বিদ্যুৎ ও প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়ে যাবে। মটরের মাধ্যমে যেমন গভীর নলকূপ থেকে পানি তোলা যাবে, তেমনি তা সেচকাজেও ব্যবহার করা যাবে। মটরচালিত রিক্সা, ভ্যানের ব্যবহারও শুরু হবে, প্রসার ঘটবে নতুন নতুন ব্যবসার। ’
বিদ্যুৎ থাকলে এ এলাকার শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে বলে মনে করছে শিক্ষার্থীরা।
লাবনী ও মারিয়া নামের ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া দুই শিক্ষার্থী বলে, প্রাথমিক ও নিম্ন মাধ্যমিকের কোনো শিক্ষকই গ্রামে থাকেন না। তারা সবাই প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে বরিশাল শহরে থাকেন। কিন্তু এ গ্রামে বিদ্যুৎ থাকলে তাদের অনেকেই ফিরে আসতে পারেন। বিদ্যুৎ থাকলে গ্রামই শহরের সব সুযোগ-সুবিধা দিতে পারে।
বিদ্যুৎ পেলে যেমন বিনোদনের জন্য টেলিভিশন দেখা যাবে, তেমনি উন্নত বিশ্বের অনেক কিছুই জানা যাবে প্রযুক্তির মাধ্যমে। সোলারের অল্প আলোতে পড়ালেখা করতে গিয়ে বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হয় বলেও জানায় এ দুই শিক্ষার্থী।
গ্রামের একমাত্র স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাঠকর্মী হাবিবুর রহমান জানান, সাড়ে ৬ হাজার মানুষের এই গ্রামে গ্রাহক সংখ্যা ৬ শ’র কাছাকাছি হবে। বিদ্যুৎ আসছে শোনার পর থেকেই মানুষের মাঝে কৌতূহল বিরাজ করছে। এরই মাঝে গ্রামের বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ও সড়কের পাশে খুঁটি বসানো হয়ে গেছে। এখন তার টানানোর কাজ শুরু হবে। প্রতিটি কাজেই গ্রামের মানুষকে সম্পৃক্ত থাকতে দেখা যাচ্ছে। বিদ্যুৎ এলে সদর উপজেলা থেকে বিচ্ছিন্ন নলচরের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটবে বলে সবার বিশ্বাস।
সার্বিক বিষয়ে বরিশাল-৫ সদর আসনের সংসদ সদস্য কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামীম বাংলানিউজকে বলেন, মনে হয় আমিই প্রথম সংসদ সদস্য যে ওই গ্রামটাতে গিয়েছি। উপজেলা চেয়ারম্যানও কখনো ওখানে যাননি। আমি যখন গিয়েছিলাম তখন ওখানকার লোকজনই এ কথা আমাকে বলেছিল। ওই এলাকা, এলাকার মানুষ এক কথায় বরিশাল থেকে বিচ্ছিন্ন। ওখানে আমরা এরই মাঝে বিদ্যুতের খুঁটি বসিয়েছি। কিছু সোলারের সড়ক বাতি দিয়েছি। আশা করি আগামী ২/৩ মাসের মধ্যে সবাই ভিন্ন ধরনের নলচরকে দেখতে পাবো।
নলচর গ্রামের মতো নদীবেষ্টিত বিচ্ছিন্ন হিজলা ও মেহেন্দিগঞ্জ এলাকাতেও বিদ্যুৎ ব্যবস্থা সংযোজনের কাজ শুরু হয়েছে। এ ক্ষেত্রে নদীর তলদেশ দিয়ে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১০১১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০২০
এমএস/এইচজে