ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

মিতা হত্যা: বিচারক ও তদন্ত কর্মকর্তার ক্ষমা প্রার্থনা

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১০৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৯, ২০২০
মিতা হত্যা: বিচারক ও তদন্ত কর্মকর্তার ক্ষমা প্রার্থনা

নাটোর: নাটোর শহরের মিতা খাতুন (২৮) হত্যা মামলার প্রধান আসামিকে অব্যাহতি দেওয়ার ঘটনায় আদালতের কারণ দর্শানো নোটিশের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্তকারি কর্মকর্তা মাসুদ রানা ও অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রশিদ নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

গত সোমবার (২৭ জানুয়ারি) দুপুরে এ সংক্রান্ত ব্যাখ্যা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক আব্দুর রহমান সরদার বরাবর জমা দেওয়া হয়। ওই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পরিদর্শক মাসুদ রানা আদালতে এ লিখিত ব্যাখ্যা জমা দেন।

ওই ব্যাখ্যায় ১৬৪ ধারায় দেওয়া আসামির জবানবন্দি তদন্তে অভিযুক্ত হত্যাকারীকে কেন অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয় তা জানানো হয়েছে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকে।

তবে এসময় বিচারক ওই মামলার প্রধান আসামি হাসপাতালের মালিক আব্দুল আজিজ মোল্লাকে গ্রেপ্তারে ব্যর্থ হওয়ায় নাটোর থানার ওসিকে আদালতে স্বশরীরে হাজির হয়ে কারণ দর্শানোর নির্দেশ দেন।  

এরআগে তাদের কাছে গত বছরের ২১ ডিসেম্বর হত্যা মামলার প্রধান আসামিকে অব্যাহতির সুপারিশ করায় তদন্তকারী কর্মকর্তা এবং তা মঞ্জুর করায় অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে এর ব্যাখ্যা চান জেলা ও দায়রা জজ আবদুর রহমান সরদার। সোমবার (২৭ জানুয়ারি) নির্ধারিত দিনে ব্যাখ্যাটি আদালতে দাখিল করা হয়। ওই ব্যাখ্যায় তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা ও ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তাদের নিজ নিজ বক্তব্য পেশ করেন।

নাটোর জজ কোর্টের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম ও জেলা গোয়েন্দা পুলিশের অফিসার ইনচার্জ (ওসি ডিবি) সৈকত হাসান বাংলানিউজকে এতথ্যটি নিশ্চিত করেছেন।  

আদালত সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালের ১৪ ডিসেম্বর সকালে শহরের চকরামপুর এলাকায় জেনারেল হাসপাতালের পঞ্চম তলায় ছুরিকাঘাতে খুন হন হাসপাতালের সেবিকা ও নলডাঙ্গা উপজেলার নশরতপুর গ্রামের লাল মোহম্মদের মেয়ে মিতা খাতুন। তিনি সেবিকার পাশাপাশি ওই হাসপাতালের অর্থ ব্যবস্থাপক হিসেবেও কর্মরত ছিলেন।

হত্যাকাণ্ডের পর নিহত মিতার ভাই শোয়েব হোসেন নাটোর সদর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে পুলিশ ওই হাসপাতালের সুইপার সাগর জমাদারকে আটক করেন।

আটক সাগর হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে সাগর জানান, মিতাকে হত্যা করেছেন হাসপাতালের মালিক আজিজ মোল্লা। তার সঙ্গে মিতার অবৈধ সম্পর্ক ছিল।

হত্যার বর্ণনায় সাগর বলেন, ঘটনার দিন হাসপাতালের ৫ম তলায় মিতার সঙ্গে আজিজ মোল্লার কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে সার্জিকাল ছুরি দিয়ে আজিজ মিতার গলায় আঘাত করেন। এরপর আজিজের নির্দেশে মিতার গলায় দ্বিতীয়বার আঘাত করেন সাগর। মৃত্যু নিশ্চিত হলে তারা দুইজনেই পালিয়ে যান। এ জবানবন্দির ভিত্তিতেই স্বত্ত্বাধিকারী আজিজকে গ্রেপ্তার করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ।

কিন্তু ২০১৯ সালের ২৮ জুলাই সাগরকে মূল আসামি করে আজিজকে মামলা থেকে অব্যাহতির সুপারিশ চেয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা অভিযোগপত্র দাখিল করেন। বিচারক মামুনুর রশীদ আজিজকে অব্যাহতি দিয়ে মামলা চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন।

বিষয়টি আদালতের নজরে এলে তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কেন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তার ব্যাখ্যা তলব করেন। একই সঙ্গে অব্যাহতির সুপারিশ কেন মঞ্জুর করা হয়েছে, সে ব্যাখ্যা দিতে নির্দেশ দেন নাটোরের অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রশিদকে।

একই সময় আদালত হাসপাতালের মালিক আজিজ মোল্লাকে ২৭ জানুয়ারির মধ্যে গ্রেপ্তার করার জন্য নাটোর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) ব্যক্তিগতভাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ওসি ওই নির্দেশ পালন করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

পরে মামলাটি বিচারের জন্য জেলা ও দায়রা জজ আদালতে এলে সাগরের আইনজীবী ১৬৪ ধারায় জবানবন্দির মূল অভিযুক্তকে অব্যাহতি দেয়ার প্রসঙ্গ তুলে ধরে জামিন আবেদন করলে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে আজিজ মোল্লাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করেন। এ সময় তদন্তকারী কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে সুপারিশ ও অব্যাহতির ব্যাখ্যা চান বিচারক আবদুর রহমান সরদার।

আদালতের আদেশ মোতাবেক তদন্তকারি কর্মকর্তা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের উপ পরিদর্শক (এসআই) মাসুদ রানা ও অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রশিদ সোমবার তাদের লিখিত ব্যাখ্যা দাখিল করেছেন।

তদন্ত কর্মকর্তা তার লিখিত ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেন, একজন নির্দোষ ব্যক্তি যাতে সন্দেহপূর্ণভাবে বিচারে সোপর্দ না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রেখে আসামি আজিজ মোল্লাকে অব্যাহিত দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। যা তদন্ত তদারকি কর্মকর্তারাও সমর্থন করেছেন। ’ তবুও তিনি নবীন তদন্তকারী কর্মকর্তা হওয়ায় তার ত্রুটি বিচ্যুতির জন্য বিচারকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রশিদ তার লিখিত ব্যাখ্যায় বলেন, এজাহারে কোনো আসামির নাম উল্লেখ নাই।

তাই তদন্তকারি কর্মকর্তা তদন্ত করে সন্দিগ্ধ আসামি আজিজ মোল্লাকে অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেওয়ায় এবং এ ব্যাপারে এজাহারকারী, কোর্ট ইন্সপেক্টর কোনো আপত্তি না করায় সার্বিক বিবেচনায় সরল বিশ্বাসে আমি অভিযোগপত্র গ্রহণ করি। প্রথমবার বিধায় মহোদয়ের নিকট নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের আদেশ দানের ক্ষেত্রে আরো বেশি সতর্ক থাকবো মর্মে নিশ্চয়তা দিচ্ছি।

আদালতে ব্যাখ্যাদানকালে বিচারক নাটোর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) আগামী ১১ ফেব্রুয়ারি মামলার পরবর্তী তারিখে স্ব-শরীরে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।  

তবে সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাজী জালাল উদ্দিন সোমবার রাতে বাংলানিউজকে জানান, তিনি এ ব্যাপারে আদালতের নির্দেশ হাতে পাননি। আদেশ পেলে অবশ্যই ব্যাখ্যা দিবেন।

এদিকে অভিযুক্ত আসামিকে কী কারণে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়েছিল তা জানতে চাইলে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের অফিসার ইনচার্জ সৈকত হাসান বাংলানিউজকে বলেন, হাসপাতাল মালিক আজিজ মোল্লাকে ফাঁসানোর জন্য জবানবন্দিতে তাকে মূল হত্যাকারী বলেন সাগর জমাদার। তদন্তে বিষয়টি স্পষ্ট হয়। জবানবন্দিতে সাগর মিতার গলায় দুজনের আঘাত দেওয়ার কথা জানালেও মরদেহের ময়না তদন্তের পর দেখা গেছে গলায় একটি আঘাত রয়েছে।

এছাড়া সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, হত্যাকাণ্ডের সময় পাঁচ তলায় শুধু সাগর উপস্থিত ছিল। আজিজ মোল্লা ঘটনাস্থলে পরে যান। জবানবন্দির সঙ্গে সিসিটিভির ফুটেজে মিল না পাওয়ায় আজিজের জন্য অব্যাহতি চাওয়া হয়।

এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও জজ কোর্টের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, অভিযোগপত্র বা অভিযুক্ত আজিজ মোল্লার সম্পৃক্ততার ব্যাপারে মামলার বাদীর কোনো আপত্তি ছিল না। আপত্তি থাকলে অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারকের পুনঃতদন্তের নির্দেশ দিতেন। নিয়মানুযায়ী পুনঃতদন্তের সুযোগ না থাকায় বিচারক আজিজ মোল্লাকে অব্যাহতির সুপারিশ করেন।

সিরাজুল ইসলাম আরও জানান, পুলিশের দেয়া ব্যাখ্যা তিনি পেয়েছেন, যা আদালতে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। তবে অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিজেই তার ব্যাখ্যা আদালতে পাঠাবেন। আর আগামী ১১ ফেব্রুয়ারি মামলার পরবর্তী তারিখে বিচারক এ ব্যাপারে আদেশ দেবেন বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ২০০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৮, ২০২০ 
এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।