ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

প্রভাবশালীদের প্রভাবে অস্তিত্ব হারাচ্ছে ‘সর্ববৃহৎ জলাবন’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯১০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১, ২০২০
প্রভাবশালীদের প্রভাবে অস্তিত্ব হারাচ্ছে ‘সর্ববৃহৎ জলাবন’

হবিগঞ্জ: গাছ কর্তন, অপরিকল্পিত মাছ শিকার ও নির্বিচারে পাখি নিধনসহ বিভিন্ন কারণে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ জলাবন ‘লক্ষ্মী বাওর’। প্রভাবশালীদের নিষ্ঠুরতায় পর্যটনের সম্ভাবনাময় এ দর্শনীয় স্থানটি দিন দিন ধ্বংসের দিকে চলে গেলেও নিরব ভূমিকায় রয়েছে প্রশাসন।

হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলায় অবস্থিত প্রায় ৩ কিলোমিটার আয়তনের জলাবনটি জনপ্রিয় রাতারগুল সোয়াম ফরেস্টের চেয়েও বড় এবং পর্যটনে সম্ভাবনাময়। যা থেকে গাছ কেটে বিক্রি এবং মাছ শিকারের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আয় করছে স্থানীয় একটি মহল।

এছাড়া প্রতিদিনই প্রকাশ্যে গাছ কেটে উজাড় করছে তারা। এখনই উদ্যোগ না নিলে দৃষ্টিনন্দন এই জলাবনটি ধ্বংস হয়ে যাবে বলে মনে করছেন প্রকৃতিপ্রেমীরা।
 
সরেজমিনে ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৫৫ সালের পর থেকে বনটিকে নিজেদের মালিকানাধীন দাবি করে ব্যবহার করে আসছেন বানিয়াচং উপজেলার ‘সৈদরটুলা ছান্দ’ নামে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। এদের নেতৃত্বে রয়েছেন এনামুল হোসেন খান বাহার ও হায়দরুজ্জামান ধন মিয়াসহ কয়েকজন স্থানীয় প্রভাবশালী। প্রতিদিন কেটে নেওয়া হচ্ছে হিজল আর করজ গাছ। এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তি প্রতিদিনই পাখি শিকার করছে এখান থেকে। প্রায়ই বনের ভেতরে মৃত এবং বন্দুকের গুলিতে আক্রান্ত অর্ধমৃত বিভিন্ন প্রজাতির পাখি পাওয়া যায়। এছাড়া বনের ভেতরে থাকা ছোট-বড় ২০টিরও বেশি জলাশয় প্রতিবছর লিজ দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রভাবশালী মহল। আর মাছ শিকার করা হচ্ছে অপরিকল্পিতভাবে। যে কারণে বন ছেড়ে চলে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির পাশু-পাখি।
 কেটে নেওয়ার পর হিজল গাছের অবশিষ্ট অংশ
কথা হয় বনের ভেতর থেকে ঘাস নিতে আসা স্থানীয় এক ব্যক্তির সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি জানান, মাছের জলমহালে ‘কাঁটা’ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে ওই বন থেকে কেটে নেওয়া গাছ। এগুলো বিক্রি করেন প্রভাবশালীরা। যা থেকে প্রতি বছর তারা পাচ্ছেন প্রায় অর্ধকোটি টাকা। তবে এ ব্যাপারে কেউ কথা বলার সাহস পাচ্ছেন না।
 
স্থানীয়রা জানান, বানিয়াচং উপজেলার খড়তি নদীর দক্ষিণ দিকে হাওরের মধ্যে অবস্থিত এই জলাবন এলাকাবাসীর কাছে ‘খড়তির জঙ্গল’ নামে পরিচিত। এ বনটিকে প্রথম-দর্শনে মনে হয় হিজল আর করচের বাগান। রয়েছে বরুণ,  কাকুরা, বাউল্লা, খাগড়া, চাইল্লা, নলসহ বিভিন্ন রকমের গুল্ম-লতা। কেউটে, লাড্ডুকা, দারাইশসহ বিভিন্ন বিষধর সাপও রয়েছে এতে। শুকনো মৌসুমে বেজি আর গুইসাপও দেখা যায়। জাতীয় পাখি দোয়েল, সাদা বক, ঘুঘু, বালি হাঁস, পানকৌড়ি, শালিকসহ বিভিন্ন প্রজাতির বিলুপ্ত প্রায় প্রাণীও রয়েছে এই বনে। শীতকালে আসা পরিযায়ী পাখিও। প্রতিদিনই এখানে দেশের বিভিন্নস্থান থেকে আসেন পর্যটকরা। এটিকে সংরক্ষণ করা হলে বাংলাদেশের মধ্যে জনপ্রিয় পর্যটন স্পট হতে পারে বলে জানান তারা।

বনের ভেতর থেকে কেটে নেওয়া গাছের মোথাশাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জহিরুল হক শাকিল বলেন, প্রাকৃতিক জলাবন একদিকে যেমন আমাদের ঐতিহ্য, অপরদিকে এর পরিবেশগত দিক অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আর আমাদের এ ঐতিহ্য নিয়ে স্থানীয় জনগণের পাশাপাশি রাষ্ট্র তথা সরকারও উদাসিন। এসব প্রাকৃতিক ঐতিহ্যরক্ষার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় আইন রয়েছে। বাংলাদেশকে এসব ঐতিহ্য রক্ষায় বৈশ্বিকভাবে জবাবদিহি করতে হয়। আমার ধারণা হবিগঞ্জে প্রাকৃতিক জলাভূমি নিয়ে যে হরিলুট চলছে সে সম্পর্কে বাংলাদেশের উচ্চ প্রশাসন অবহিত নয়। বন উজারের তথ্য নেই আন্তর্জাতিক প্লাটফর্মেও। আর সেজন্যই আমরা আমাদের এরকম একটি প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত ঐতিহ্য হারাতে বসেছি।
নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বনের ভেতরে উপড়ে ফেলা গাছ
যুক্তরাজ্যে উন্নয়ন প্রশাসনে পিএইচডি করা ড. জহিরুল হক শাকিল আরো বলেন, সভ্য কোনো দেশে প্রাকৃতিক সম্পদের এ ধরনের লুটপাট আশা করা যায় না। বহির্বিশ্ব যখন এরকম একটি জলাভূমি ধ্বংস করার খবর প্রচারিত হবে তখন আমরা জাতি হিসেবে খাটো ও নিন্দার পাত্র হবো।

বানিয়াচং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মামুন খন্দকার বলেন, জলাবনটির ৩৭৫ একর জায়গার মধ্যে প্রায় ৭৫ একর সরকারি খাস সম্পত্তি। তাও আবার মামলাভুক্ত। যে কারণে এখান থেকে গাছ কেটে নিলে প্রশাসন বাধা দিতে পারছে না। তবে লক্ষ্মী বাওরকে পর্যটন স্পট হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৪০৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১, ২০২০
এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।