ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

ছেলেরা মাছ ধরতে নদীতে, মেয়েরা স্কুলে…

মুশফিক সৌরভ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩১১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১, ২০২০
ছেলেরা মাছ ধরতে নদীতে, মেয়েরা স্কুলে…

বরিশাল: বরিশাল সদর উপজেলার একটি বিচ্ছিন্ন জনপদ চরমোনাই ইউনিয়িনের নলচর গ্রাম। আড়িয়াল খাঁ ও কালাদবদর নদী ঘিরে থাকা ছোট্ট এ গ্রামে রয়েছে প্রায় ৬ হাজার মানুষের বসবাস। নদী থেকে মাছ আহরণ ও কৃষি কাজ করা এ গ্রামের পুরুষদের প্রধান কাজ। শিক্ষা-দীক্ষায় তাদের যেমন আগ্রহ নেই, তেমনই সুযোগও নেই। তবে শিক্ষা-দীক্ষায় অনেকটাই এগিয়ে গেছেন এই গ্রামটির নারীরা। 

গ্রামের অনেক বাড়ি রয়েছে যেখানে মাত্র পঞ্চম শ্রেণি পাস করা পুরুষের দেখা পাওয়া কঠিন, সেখানে ওই বাড়িতেই হয়তো এসএসসি পাস করা নারী রয়েছেন; যিনি সংসার সামলানোর কাজ করছেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, ঘড়ির কাঁটা মেপে ইঞ্জিন চালিত নৌকায় চেপে উপজেলা ও ইউনিয়নের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা নলচরের এই মানুষদের শিক্ষা-দীক্ষার জন্য প্রাথমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ও রয়েছে।

তবে তা চলছে কোনোরকমে। তারপরও ভেঙে পড়া গ্রামীণ সড়কের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে এমন এলাকায় কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ নেই। তবে যেশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে সেখানে শিক্ষার্থীর কোনো কমতি নেই।  

তবে নলচর ও পাশের ভোলানাথ গ্রামের বিদ্যালয়গুলোতে রয়েছে মেয়ে শিক্ষার্থীদের আধিক্য। প্রাথমিক স্তরে প্রতিটি ক্লাসে ছেলেদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি মেয়ে শিক্ষার্থী রয়েছে। আর মাধ্যমিকে গিয়ে তা সেই ব্যবধান দাঁড়াচ্ছে তিনগুণে।  

এর কারণ হিসেবে স্থানীয়রা বলছেন, নদীবেষ্টিত নলচরের বেশিরভাগ মানুষ এখনো সেভাবে স্বচ্ছল নয়। তাদের সবারই প্রধান পেশা আশপাশের নদী থেকে মাছ শিকার ও কৃষিকাজ করা। আর যারাও বা একটু স্বচ্ছল তারা যেমন গ্রামে থাকতে আগ্রহী নন, আবার সুযোগ না থাকায় উচ্চশিক্ষার জন্য তাদের সন্তানদের চলে যেতে হয় শহরে। তবে বেশিরভাগ পরিবার শহুরে ব্যয় মেটাতে সক্ষম নয়।  

ফলে সবমিলিয়ে গ্রামজুড়ে যে ছেলে বা পুরুষ মানুষের বসবাস তারা পরিবারের দেখভাল করেই দিন কাটাচ্ছে।  এজন্য ঘরের ছেলে সন্তানটি একটু বড় হলেই তাকে ভাবতে হয় পরিবারের কথা, আয় রোজগারের কথা। তাই তাদের কেউ হয়তো মাছ শিকার নয়তো কৃষিকাজে জড়িয়ে যোগ দিচ্ছেন অভিভাবকদের সঙ্গে। ফলে গ্রামের বেশির ভাগ ছেলেরা তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির মধ্যেই স্কুল ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন।  

গ্রামের বাসিন্দা ও পেশায় জেলে সেরাজ খাঁ বাংলানিউজকে বলেন, যেখানে ছেলেরা পরিবারের হাল ধরছে, সেখানে একই সময়ে ওই পরিবারের মেয়ে সন্তানটি পড়াশোনায় ব্যস্ত সময় পার করেছ। এ গ্রামের প্রায় প্রতিটি মেয়ে স্কুলে যাচ্ছে। তাদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পরিবারের প্রতিটি সদস্য সহযোগিতাও করে।  

‘আর গ্রামটিতে কোনো মাদকের বিস্তার ও বখাটেদের আধিক্য না থাকায় এখানে মেয়েরা নির্ভয়ে ঘর থেকে বের হয়ে চলাফেরা করতে পারছে। ’

তিনি বলেন, গৃহস্থলী কাজ ছাড়া গ্রামের নারীদের তেমন কোনো কাজ করতে হয় না, আর ঘরে যে মেয়েটি থাকছে তাকে তেমন কোনো কাজ করতে হয় না, ফলে সে ঘরে বসে না থেকে স্কুলে যাচ্ছে। আর পরিবারের যে কাজে মেয়েরা সাহায্য করে, তাতে পড়াশোনারও কোনো ক্ষতি হয় না।  

তবে তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণিতে ঝরে পড়ে পরিবারের হাল ধরা কিশোর সুজন ও ফরিদ নামের দুই সহোদর বলছেন ভিন্ন কথা। তারা জানান, তাদের সময়ে এখনকার মতো স্কুলই ছিলো না আশেপাশে। আগে তো মাধ্যমিক স্তর কিংবা কলেজে পড়তে হলে হয় আড়িয়াল খাঁ, কালাবদর পাড়ি দিয়ে মেহেন্দিগঞ্জের লেঙ্গুটিয়া, বরিশাল সদর উপজেলার বুখাইনগর নয়তো বরিশাল শহরে যেতে হতো। আর এখন তো পাশের গ্রামের একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে, ফলে এসএসসি পর্যন্ত পড়তে পারছে গ্রামের ছেলে-মেয়েরা।

এদিকে লেঙ্গুটিয়া মুসলিম উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী শান্ত জানান, তাদের যেসব ছেলে সহপাঠী পঞ্চম শ্রেণিতে নলচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ও ভোলানাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে তাদের অনেকেই পঞ্চম শ্রেণির পর আর ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হননি। যার মধ্যে বেশিরভাগই মাছধরার পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করেছে, আর কয়েকজন বরিশালে চলে গেছেন।

একই কথা একই শ্রেণিতে পড়ুয়া জাহিদ, লাবনী, নিশিতা, জামিলারও।  

গ্রামের বাসিন্দা ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাঠকর্মী হাবিবুর রহমান জানান, এ গ্রামে আগে মাধ্যমিক স্তরের বিদ্যালয় ছিলো না, কিন্তু স্থানীয় কিছু লোকের উদ্যোগে দুইবছর আগে পাশের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার লেঙ্গুটিয়া মুসলিম উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একটি শাখা ভোলানাথে নিয়ে আসা হয়েছে। বর্তমানে বিদ্যালয়টির কার্যক্রম ভোলানাথ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবনে হচ্ছে। তবে দ্রুত বিদ্যালয়ের শাখাটি পাশেই আলাদা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।  

তিনি বলেন, এ বিদ্যালয়টি আসার পরে এখন আর মেট্রিক পাস করতে কাউকে কষ্ট করে নদী পাড়ি দিয়ে অন্যত্র যেতে হচ্ছে না।  

তবে উপজেলা সদরের সঙ্গে সড়ক পথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এ গ্রামটিতে এখনো বিদ্যুৎ না থাকা, সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়ন না হওয়ার কারণে বেশিরভাগ শিক্ষকই গ্রামে থাকেন না। ফলে বিদ্যালয়গুলোতে নির্ধারিত সময়ে ক্লাস পরিচালনা যেমন সম্ভব হয় না, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোতে শিক্ষকদের কাছে পাচ্ছেন না শিক্ষার্থীরা।

লেঙ্গুটিয়া মুসলিম উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভোলানাথ শাখার প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালনকারী সহকারী শিক্ষক মো. শাখাওয়াত হোসেন বলেন, মাত্র ২ বছর ধরে মাধ্যমিক বিদ্যালয়টির কার্যক্রম শুরু হলেও এখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমানে ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত ৩০০ শিক্ষার্থী রয়েছে। যার মধ্যে মেয়েরাই রয়েছে দ্বিগুণের বেশি।

‘আশা করছি ছেলেদের উপস্থিতিও দিনে দিনে বাড়বে। এছাড়া বিদ্যালয়টি ভালো ফলাফলও বয়ে আনতে শুরু করেছে। সার্বিক সহযোগিতা অব্যাহত থাকলে আরো ভালো কিছু করা সম্ভব হবে। ’ 

এ বিষয়ে বরিশাল সদর উপজেলার ভাইস-চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মাহববুর রহমান মধু বলেন, এই জনপদে দীর্ঘদিন পর হলেও বেশি কিছু উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সার্বিক বিষয়ে উন্নয়ন সাধিত হবে।  

বর্তমানে গ্রামটিতে বিদ্যুৎ পৌছে দেওয়ার কাজ হচ্ছে, পর্যায়ক্রমে বাকি সমস্যাগুলোর সমাধান করা হবে বলে জানান তিনি।  

বাংলাদেশ সময়: ১৮০৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১, ২০২০
এমএস/এমএ 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।