লালমনিরহাট: ‘ধর্মীয় অনুভূতি প্রশমন করা সহজ ছিল না। এছাড়া অতিরিক্ত ফোর্স আসতে দেরি হওয়ায় মাত্র ২০ জন ফোর্স দিয়ে পাঁচ/ছয়শ’ মানুষকে থামানো অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।
লালমনিরহাটের বুড়িমারীতে কোরআন অবমাননার গুজব ছড়িয়ে শহিদুন্নবী জুয়েল নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা ও মরদেহ পুড়িয়ে ছাই করার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বর্ণনা দিতে গিয়ে পাটগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুন নাহার সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন।
এর আগে বৃহস্পতিবার (২৯ অক্টোবর) বিকেলে পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী বাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে এ ঘটনা ঘটে।
নিহত শহিদুন্নবী জুয়েল রংপুর শহরের শালবন মিস্ত্রিপাড়ার আব্দুল ওয়াজেদ মিয়ার ছেলে। তিনি রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক গ্রন্থাগারিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র। গত বছর চাকরিচ্যুত হওয়ায় কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন তিনি।
পাটগ্রামের ইউএনও ঘটনার লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘খবর পেয়েই উপজেলা চেয়ারম্যানসহ বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) যাই। তখন পরিষদ মাঠে পাঁচ/ছয়শ’ লোক ছিলেন। এ বিপুল জনতাকে প্রশমন করার মত ফোর্স আমাদের ছিল না। তাই বৈঠক করে বিষয়টি নিষ্পত্তির পথ খুঁজছিলাম। বৈঠকে মুয়াজ্জিন বা ইমাম ছিলেন না। উপজেলা ও ইউপি চেয়ারম্যানসহ একটি কক্ষে বসেছিলাম আমরা। অতিরিক্ত ফোর্স আসতে অনেকটা সময় লেগেছে। আমরা জনতাকে শান্ত করতে মাইকিং করেছি। প্রথম দিকে কিছুটা শান্ত হয়েছিল। এরপর কিছু যুবক এসে পরিবেশ উত্তপ্ত করে দেন। অবশেষে বাধ্য হয়ে ফাঁকা গুলির নির্দেশ দিয়েছি। গুলিও চলেছে ১৭ রাউন্ড। কিন্তু তাদের প্রশমন করা যায়নি। ধর্মীয় অনুভূতি প্রশমন করা সহজ ছিল না। ’
লোকজনের দাবি, দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে আটক যুবককে অন্যত্র সরালে এমন ঘটনা এড়ানো যেতো। এ বিষয়ে ইউএনও কামরুন নাহার বলেন, ‘সিদ্ধান্ত নিতে আমাদের কোনো দেরি হয়নি। ভেতরের দু'জনকে যেমন দেখতে হয়। বাইরের হাজার হাজার জনতাকেও আমাকে দেখতে হয়। অতিরিক্ত ফোর্স হিসেবে বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) ডেকেছি। তারাও আসতে বিলম্ব করায় এমনটি হয়েছে। জেলা সদর থেকে পাটগ্রামের দূরুত্ব প্রায় শত কিলোমিটার। এতদূর থেকে ফোর্স আসতে সময় লাগা অস্বাভাবিক নয়। ’
‘হামলাকারীদের বুড়িমারী ইউপি চেয়ারম্যান চেনেন না। তাই তারা বহিরাগত বলে মনে হচ্ছে,’ যোগ করেন তিনি।
সময়মতো ফোর্স আসতে পারেনি, তাহলে বহিরাগতরা কীভাবে ঘটনাস্থলে পৌঁছলো- এমন প্রশ্নে ইউএনও বলেন, ‘তারা কীভাবে এসেছে, সেটা তদন্ত হচ্ছে। এছাড়া বহিরাগতরা হয়তো আগেই বুড়িমারী এসেছিলেন। হামলাকারীরা গেট ভেঙে ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের কক্ষে গিয়ে জুয়েলকে পিটিয়ে হত্যা করেন। এ সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। আমরা স্থানীয় দুই যুবকের সহায়তায় জুয়েলের বন্ধু সুলতান যোবায়েরকে রক্ষা করে সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে এনসি ব্যাংকে আশ্রয় নিয়েছিলাম। এ সময় উৎসুক জনতার কিছু অংশ আমাদের পিছু নিয়েছিল সুলতান যোবায়েরকে ছিনিয়ে নিতে। ’
‘প্রথম দিকে কোরআন অবমাননার বিষয়টি জানতে পারিনি। জনতাকে সামাল দিতেই সময় গড়িয়েছে। পরে তদন্তে গিয়ে কোরআন অবমাননার গুজবের বিষয়টি জানতে পারি। নিহত জুয়েল বা তার বন্ধু কোরআন অবমাননা করেছেন এমন একজনও প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী পাওয়া যায়নি। সবাই শুনেই এসেছিলেন, কেউ প্রত্যক্ষভাবে দেখেননি। কোরআন অবমাননা করতে দেখেছেন- এমন একজনও প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায়নি। এটা স্রেফ একটি গুজব,’ বলেন তিনি।
কোনো গোষ্ঠীর ইন্ধন রয়েছে কি না? কেউ ষড়যন্ত্র করে বুড়িমারীকে উত্তপ্ত করেছে কি না, তা মাথায় রেখে তদন্ত চলছে বলেও জানান তিনি।
গত বৃহস্পতিবার বুড়িমারী বাজার জামে মসজিদে জুয়েল আছরের নামাজ শেষে পড়ার জন্য কোরআন শরিফ নিতে গেলে কোরআন ও কয়েকটি হাদিস বই মেঝেতে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে তিনি কোরআন তুলে চুমু খান। কিন্তু গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে তিনি কোরআন অবমাননা করেছেন। এতে উত্তেজিত হয়ে লোকজন তাকে ও তার সঙ্গে থাকা সুলতান যোবায়েরকে ধরে ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে নিয়ে যান। পরে গুজব শুনে কয়েকশ’ লোক জড়ো হয়ে ইউপি ভবনের গেট ও দরজা ভেঙে শহিদুন্নবী জুয়েল ও তার সঙ্গীকে গণপিটুনি দেন। পিটুনিতে জুয়েল মারা গেলে তার মরদেহ পুড়িয়ে ছাই করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় তিনটি মামলা নিয়ে পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ দিকে ঘটনাটি তদন্তে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তিন সদস্যের তদন্ত দল রোববার বুড়িমারীতে এসে তদন্ত শুরু করেছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৭২১ ঘণ্টা, নভেম্বর ১, ২০২০
এসআই