খুলনা: খুলনায় ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে ধর্ষণের ঘটনা। মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে ৪টি ধর্ষণের শিকার হয়েছে শিশুসহ গৃহবধূ।
গত ০১ নভেম্বর থেকে ০৩ নভেম্বর পর্যন্ত চার নারী ও শিশুসহ গত তিন মাসে অর্ধশত নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এসব ঘটনায় মামলা হলেও ভুক্তভোগী পরিবারগুলো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। ধর্ষক ও ধর্ষকের পরিবার, আত্মীয়-স্বজন প্রভাবশালী হওয়ায় মামলা প্রত্যাহারের জন্য হুমকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, গত রোববার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত তিন দিনে জেলা বটিয়াঘাটা ও ডুমুরিয়া এবং নগরীর খালিশপুর থানা এলাকায় ৪ নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে মঙ্গলবার (৩ নভেম্বর ) ডুমুরিয়ার বানিয়াখালী এলাকায় ৫ম শেণির ছাত্রীকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করে একই এলাকার সাব্বির হোসেন নামে এক যুবক।
একই দিন নগরীর খালিশপুরের বাংলার মোড় এলাকার এক গৃহবধূ পাওনা টাকা আনতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলায় ধর্ষণের শিকার হয়ে এক মাদ্রাসাছাত্রী (১২) তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় মঙ্গলবার দুপুরে বটিয়াঘাটার বিরাট বাজারের স্থানীয় যুবকরা অভিযুক্ত অজিয়ার মোল্লাকে (৪০) আটক করে পুলিশে দেন। আটক অজিয়ার বটিয়াঘাটার কুলটিয়া গ্রামের বাহের মোল্লার ছেলে।
অপরদিকে বটিয়াঘাটা উপজেলার সুকদাড়া এলাকায় ১২ বছর বয়সী এক মাদরাসার ছাত্রীকে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে ধর্ষণ করেছেন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক সঞ্জয় শীল (৫০)। এসব ঘটনায় পৃথক মামলাও হয়েছে। কিন্তু ধর্ষণের শিকার হওয়া পরিবারগুলোর মাঝে অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে।
খুলনা মেডিক্যাল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) সূত্রে জানা যায়, ওসিসিতে গত তিন মাসে ৫৩ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়ে এখানে এসেছে। এর মধ্যে ৯ জনের বয়স ১৮ বছরের নিচে। অন্যদের ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে ও ৬৫ বছরের মধ্যে। গত ২৪ সেপ্টেম্বর ধর্ষণের শিকার হন নগরীর খালিশপুর এলাকায় ৬৫ বছর বয়সী একজন বৃদ্ধা। এছাড়া বেশিরভাগ ঘটনাই খুলনার রূপসা, তেরখাদা, ডুমুরিয়া, দাকোপ, বটিয়াঘাটা ও পাইকগাছা উপজেলার।
সূত্রে আরও জানা গেছে, কয়রা উপজেলার বালিয়াপুর গ্রামের সাড়ে ৪ বছরের শিশু ধর্ষণের শিকার হয়ে গত ১৮ আগস্ট ওসিসিতে ভর্তি হয়। গত ১৪ সেপ্টেম্বর তেরখাদা উপজেলায় পুলিশ সদস্য চতুর্থ শ্রেণির এক ছাত্রীকে (৯) ধর্ষণ করে। এ ঘটনায় পুলিশ উপজেলার মধুপুর ইউনিয়নের মোকামপুর গ্রামের রেজাউল ইসলামকে (২২) গ্রেফতার করে। তিনি নাটোর পুলিশ লাইন্সে কর্মরত। ধর্ষক রেজাউলের বাবাও পুলিশে চাকুরী করেন। তিনিই এখন ভুক্তভোগী পরিবারকে মামলাটি প্রত্যাহারের জন্য চাপ দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর যশোরের কেশবপুরের পল্লীতে শারীরিক প্রতিবন্ধী এক কিশোরীকে (২০) ধর্ষণের অভিযোগে আবদুল মোমিন (৪০) নামে এক ব্যক্তিকে আটক করে পুলিশ। গত ২৮ সেপ্টেম্বর খুলনার রূপসা উপজেলার নৈহাটি ইউনিয়নের পশ্চিম জাবুসা এলাকায় দ্বিতীয় শ্রেণির শিশু শিক্ষার্থী তার খালার বাসায় বেড়াতে এসে ধর্ষণের শিকার হয়। প্রতিবেশী বখাটে ফজর মোল্লা বাবু শিশুটিকে ফুসলিয়ে তার বাড়িতে নিয়ে ধর্ষণ করে। এ ঘটনায় শিশুটির মায়ের দায়েরকৃত মামলায় ধর্ষক বাবুকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তবে এ ঘটনার পর ধর্ষকের ভাই ইউনুসসহ তার স্বজনরা মামলা তুলে নিতে নির্যাতিত শিশুর পরিবারের ওপর চাপ প্রয়োগ করছে বলে অভিযোগ করেন তার স্বজনরা।
এদিকে আইনে সর্বোচ্চ শাস্তির পরিবর্তনে মৃত্যুদন্ডের বিধান এনেও কমছে না এসব ধর্ষণের মতো নির্মমতা। ক্রমবর্ধমান ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে খুলনায় মানববন্ধনও অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
জনউদ্যোগ খুলনার সদস্য সচিব মহেন্দ্রনাথ সেন বাংলানিউজকে বলেন, খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের (খুমেকে) ফরেনসিক ফরেনসিক বিভাগের অধ্যাপক থেকে প্রভাষকসহ ৬টি পদের সবকটিই শূন্য। ওই বিভাগের রিপোর্টের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে খুন, অপমৃত্যু, ধর্ষণসহ গুরুত্বপূর্ণ মামলার ন্যায় বিচার। সময়মত ধর্ষণের আলামত সংগ্রহ হচ্ছে না, হচ্ছে না পরীক্ষা, ফলে ন্যায়বিচার প্রাপ্তি বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। তাই গত কয়েক মাস ধরে ফাইলবন্দি শতাধিক রিপোর্ট।
নারী নেত্রী অ্যাডভোকেট শামীমা সুলতানা শীলু বাংলানিউজকে বলেন, সামাজিক অবক্ষয় এবং পারিবারিক অনুশাসন না মানার কারণে এ সমস্যা হচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ডে যারা জড়িত, তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ মাদকাসক্ত। পাশাপাশি অপ্রাপ্ত বয়স্কদের কাছে চলে গেছে মুঠোফোন। আমাদের সামাজিক বন্ধন ও আইনের শাসন নিশ্চিত করতে পারলে দুর্বৃত্তরা ধর্ষণ ও নির্যাতিতদের হুমকি দেওয়ার সাহসও পেত না।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. কাজী মাসুদুল আলম বাংলানিউজকে বলেন, এইসব ধর্ষকদের কারণে পুরুষ সমাজের মাথা আজ নুয়ে পড়েছে, জাতি হিসাবে আমরা ছোট হয়ে গেছি। এই ধর্ষকদের সামাজিকভাবে বয়কট করা বাঞ্ছনীয়। মোবাইল ও সোশ্যাল নেটওয়ার্কের অতি ব্যবহার, টিকটক, লাইকি’র মত সমাজ ও মনন বিধ্বংসী অ্যাপ্লিকেশন পারিবারিক বন্ধন আলগা করে দিচ্ছে। সেই সঙ্গে ধর্মীয় ও সামাজিক অনুশাসনের প্রতি অবহেলা, জীবনের থেকে অর্থের প্রতি আসক্তি আমাদের জীবন ব্যবস্থাকে বেসামাল করে তুলেছে। সরকারের দায়িত্ব আশু সোশ্যাল নেটওয়ার্কের অপব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণ করা, প্রয়োজনে আমাদের সমাজের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ অ্যাপ্লিকেশনগুলোকে বন্ধ করে দেওয়া। পাশাপাশি স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষা কারিকুলামে নৈতিকতা শিক্ষা, খেলাধুলা, শরীরচর্চা এবং স্বেচ্ছাশ্রমকে বাধ্যতামূলক করা।
বাংলাদেশ সময়: ০১২৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৪, ২০২০
এমআরএম/ইউবি