মাদারীপুর: ইদানিং শিশু-কিশোরদের মধ্যে বেড়েছে মোবাইল ফোন ব্যবহারের প্রবণতা। ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ায় শিশু-কিশোররা ব্যস্ততা থাকে ইন্টারনেট ভিত্তিক গেমস ও নানা ভিডিও দেখা নিয়ে।
এছাড়াও গ্রাম পর্যায়ের শিশু-কিশোরদের মধ্যে টিকটক আর লাইকি নিয়ে উন্মাদনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এভাবেই বয়সের সঙ্গে সঙ্গে নৈতিক অবক্ষয় ঘটছে তাদের। উঠতি বয়সে বখাটেপনা, দাদাগিরির মনোভাব নিয়ে নানান অনৈতিক কাজও করে বেড়াচ্ছে তারা। সংঘটিত হচ্ছে কিশোর অপরাধ। মফস্বল এলাকায় গ্যাং কালচারে প্রবেশ ঘটছে এভাবেই।
স্থানীয় সচেতন মহলের একাধিক ব্যক্তি এভাবেই ব্যাখ্যা করেন বিষয়টির।
সরেজমিনে ঘুরে এবং একাধিক মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমান সময়ে মাল্টিমিডিয়া মোবাইল সেট অর্থাৎ অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেখা যায় শিশু-কিশোরদের। প্রাথমিকের গন্ডি পার না হওয়া এক শ্রেণির শিশু থেকে শুরু করে উঠতি বয়সীদের হাতে হাতে এখন অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন। ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ায় ইন্টারনেটভিত্তিক নানা গেমস নিয়ে মেতে থাকে কিশোরদের দল। ফোনে টাকা বাজি ধরে লুডু খেলে বলেও জানা গেছে।
এছাড়া ফোনসেট এবং ইন্টারনেট হাতের মুঠোয় থাকায় সহজেই পর্নো ভিডিওসহ অশ্লীল ও অনৈতিক ভিডিও দেখার সুযোগ অনায়াসেই পেয়ে যাচ্ছে অপরিণত বয়সীরা। আর এসব শিশু-কিশোরই একটু বড় হলে জড়িয়ে যাচ্ছে নানা অপকর্মে। দলবেঁধে আড্ডা দেওয়া, মাদকদ্রব্য গ্রহণ, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করাসহ নানা অপরাধমূলক কাজে সম্পৃক্ত হচ্ছে তারা। এসব কাজকে স্মার্টনেসও মনে করে তারা।
জেলার বিভিন্ন স্থানের মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, পরিবারের অসচেতনতার কারণেই কিশোররা বখাটে হয়ে যাচ্ছে। অপরিণত বয়সে মোবাইল ফোন ব্যবহারে বাধা না দেওয়ায় দিন দিন মোবাইল ব্যবহারে আসক্ত হয়ে পড়ছে তারা। লেখাপড়া থেকেও দূরে সরে যাচ্ছে। সন্ধ্যার পর বাজারে, রাস্তার মোড়ে আড্ডা দেওয়া এবং গ্রাম-পাড়া-মহল্লায় তৈরি হচ্ছে তাদের একাধিক গ্রুপ। বড়দের সঙ্গে বেয়াদবি, শিক্ষকদের অবমূল্যায়ন করতেও দ্বিধা করে না উঠতি বয়সীদের একটা শ্রেণি। আধিপত্য নিয়েও পরস্পরকে বিরোধে জড়াতে দেখা যায়। মূলত মোবাইল ফোনের অপব্যবহারের ফলেই উঠতি বয়সীদের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সূচনা বলে শিক্ষক ও সচেতন অভিভাবকদের ধারণা।
মাদারীপুর জেলা কারাগার সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর মাদারীপুর জেলায় নানা অপরাধে গ্রেফতার হওয়ার পর ঢাকার টঙ্গী কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে ১৩ জন কিশোরকে। কিশোরী ভিকটিম নিরাপদ হেফাজতী হিসেবে ফরিদপুর কিশোরী সেফ হোমে পাঠানো হয়েছে ১৩ জন কিশোরীকে। এছাড়াও ৩ জন কিশোর ও ১ জন কিশোরী জামিনে মুক্ত রয়েছে।
সূত্রটি আরো জানায়, কিশোরদের প্রায় সবাই চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, মাদক, খুন, ইভটিজিংসহ বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার এবং কিশোরীরা পালিয়ে বিয়ে করাজনিত কারণে অভিযুক্ত।
শিবচর থানা সূত্র জানায়, জেলার শিবচর উপজেলার মিনি চাইনিজ রেস্টুরেন্ট ও কফিশপগুলোতে স্কুল ফাঁকি দিয়ে ছেলে-মেয়েদের আড্ডা জমতো। উঠতি বয়সী ছেলেরা এসে আড্ডা দিতো এসব রেস্টুরেন্ট ও কফিশপে। অভিভাবকদের অভিযোগ পেয়ে শিবচর থানা পুলিশ অভিযান চালায় এসব রেস্টুরেন্ট ও কফিশপে। এসময় স্কুল চলাকালীন ছেলে-মেয়েদের আড্ডার বিষয়ে কঠোর হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।
শিবচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম আজাদ বলেন, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর আগে নিয়মিত পর্যবেক্ষণে ছিল এসব চাইনিজ রেস্টুরেন্ট ও কফিশপ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে যাতে আড্ডা না দিতে পারে সেজন্য পুলিশের টহল ছিল। এক শ্রেণির উঠতি বয়সী উচ্ছৃঙ্খল কিশোর ও যুবকদের আড্ডা বন্ধ করতে পুলিশের তৎপরতা রয়েছে।
শিবচরের নূরুল আমিন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এখলাস উদ্দিন চুন্নু বলেন, মোবাইল ফোনের অপপ্রয়োগে উঠতি বয়সের ছেলে মেয়ে এমন কি কমলমতি শিক্ষার্থীরা বখাটেপনায় জড়াচ্ছে। মোবাইলে গেম খেলতে গিয়ে তারা সন্ত্রাসীদের কিছু ভাষা বা অপরাধীদের ভাষা মনের অজান্তে মস্তিষ্কে ধারণ করছে এবং বাস্তবে প্রয়োগ করছে, এভাবেই ধীরে ধীরে বখাটেপনা ও অপরাধ জগতে প্রবেশ করছে। মোবাইল আসক্ত উঠতি বয়সীরা আসক্তির চরম পর্যায়ে মোবাইলের এমবি/টাকা যোগাতে পরিবার ও নিকট জনদের থেকে টাকা বা মূল্যবান জিনিস চুরি করতেও পিছপা হচ্ছে না। এমনকি বখাটেপনাসহ নানান অপরাধমূলক কাজ করছে তারা। এর থেকে পরিত্রাণের জন্য পরিবারের সচেতনতার বিকল্প নেই।
মাদারীপুর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুব হাসান বলেন, কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে জেলা পুলিশ সার্বক্ষণিক কাজ করে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের বিট পুলিশিং কার্যক্রমও বেশ ভূমিকা রাখছে। মাঠ পর্যায়ে কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি একইসঙ্গে পজিটিভ প্যারেন্টিং কার্যক্রম করে যাচ্ছি আমরা। কিশোর বয়সে যাতে করে ছেলে মেয়েরা বখাটে হয়ে না যায়, সেই দিকটি যেন তার বাবা-মা বা পরিবার নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে।
তিনি আরো বলেন, কিশোর বয়সে তাদের হাতে তুলে মোবাইল ফোন দিয়ে অনেকটাই ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়। কারণ মোবাইল ফোনের সঠিক ব্যবহার করার মতো বয়সী ওরা নয়। আর বাবা-মাকেই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১১০২ ঘণ্টা, নভেম্বর ১০, ২০২০
আরএ