ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

কোনো ধরনের উশৃঙ্খল আচরণ করেননি আনিসুল করিম

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ১০, ২০২০
কোনো ধরনের উশৃঙ্খল আচরণ করেননি আনিসুল করিম

ঢাকা: সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আনিসুল করিমকে এলোপাথারি মারধর করেছেন রাজধানীর আদাবরে মাইন্ড এইড হাসপাতালের স্টাফরা। মারধরের মধ্যেই মৃত্যু হয় মানসিক চিকিৎসাসেবা নিতে যাওয়া এ পুলিশ কর্মকর্তার।

তবে আনিসুল করিমের সঙ্গে ধস্তাধস্তি বা তাকে মারধরের মতো কোনো পরিস্থিতিই সৃষ্টি হয়নি। ঘটনার সময় কোনো ধরনের উশৃঙ্খল আচরণ করেননি বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাথমিকভাবে পরিকল্পিতভাবে মারধর করে আনিসুল করিমকে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মানসিক হাসপাতাল হিসেবে রোগীদের চিকিৎসার নামে আসা মাত্রই ‌‌‘মারধর করে বেঁধে ফেলতে হবে’ সম্ভবত এমন হীন উদ্দেশ্য থেকেও এমন কর্মকাণ্ড ঘটাতে পারে। তবে সার্বিক তদন্তে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে।

ঘটনার বিবরণে জানা যায়, সোমবার (৯ নভেম্বর) আদাবরের ওই হাসপাতালে যাওয়ার পর একটি রুমে বসে নাস্তা খান এএসপি আনিসুল করিম। কিছুক্ষণ পর তিনি ওয়াশরুমে যেতে চাইলে বেলা আনুমানিক পৌনে ১২ টার দিকে হাসপাতালের মার্কেটিং ম্যানেজার আরিফ মাহমুদ জয় তাকে দ্বিতীয় তলায় নিয়ে যান। এ সময় এএসপি আনিসুল করিমের সঙ্গে তার বোন উম্মে সালমা ওপরে যেতে চাইলে আরিফ ও রেদোয়ান সাব্বির তাকে বাধা দিয়ে দ্বিতীয় তলার কলাপসিবল গেট আটকে দেন।

বেলা ১২ টার দিকে আরিফ মাহমুদ নিচে এসে তার বোনকে উপরে যাওয়ার জন্য ডাক দেন। এরপর তার বোনসহ পরিবারের সদস্যরা উপরে গিয়ে একটি কক্ষের মেঝেতে আনিসুল করিমকে নিস্তেজ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। এরপর পরিবারের সদস্যরা আনিসুল করিমকে উদ্ধার করে অ্যাম্বুলেন্স যোগে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক ১২ টা ৫৮ মিনিটে তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

পরবর্তীতে হাসপাতালের সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পৌনে ১২ টার দিকে হাসপাতালের কয়েকজন স্টাফ আনিসুল করিমকে মারতে মারতে দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষে নিয়ে যান। তাকে কক্ষের মেঝেতে জোরপূর্বক উপুড় করে ফেলে ৩ থেকে ৪ জন হাঁটু দিয়ে পিঠের উপর চেপে বসেন। কয়েকজন পিঠমোড়া করে একটি ওড়না দিয়ে তার দুই হাত বেঁধে ফেলেন। কয়েকজন কনুই দিয়ে এএসপি আনিসুল করিমের ঘাড়ে ও মাথায় আঘাত করতে থাকেন। একজন তার মাথার উপরে চেপে বসেন এবং সবাই মিলে তাকে উপর্যুপরি মারধর করতে থাকেন। একপর্যায়ে ১২ টার দিকে তিনি নিস্তেজ হয়ে পড়েন।

মঙ্গলবার (১০ নভেম্বর) এ ঘটনায় আদাবর থানায় একটি হত্যা মামলা (নং-৯) দায়ের করা হয়েছে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত মারধরের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ১০ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হাসপাতালের স্টাফরা জানায়, হাসপাতালে এএসপি উত্তেজিত হয়ে আরিফ মাহমুদ জয়কে মারেন। আরিফ মাহমুদের নির্দেশে আনিসুলকে জোরপূর্বক ধরে এবং ধস্তাধস্তির মাধ্যমে ওই কক্ষে নিয়ে যায় তারা।

তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এএসপি আনিসুল করিম বেশ ভদ্রভাবে হেঁটে উপরে আসেন। তিনি কোনো ধরনের উশৃঙ্খল আচরণ করেননি। হেঁটে আসার সময় কারো সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ও করেননি। দ্বিতীয় তলায় আসার পর কিছু বুঝে উঠার আগেই তাকে মারধর শুরু করে একটি ছোট কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়।

হাসপাতালের রান্নার কাজে নিয়োজিত শারমিন আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, আমরা নিচেই থাকি। তিনি যখন হাসপাতালে আসেন তখন আমরা দেখেছি। কিছুক্ষণ পর তিনি হেঁটেই হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় ওঠেন। এর কিছুক্ষণ পর শুনি তিনি মারা গেছেন। শুনেছি ওয়ার্ডবয়রা তাকে মারধর করেছেন।

দ্বিতীয় তলাতে ২০ দিন ধরে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছিলেন কক্সবাজারের বাসিন্দা আরিফুল হক চৌধুরী নামে একজন। তিনি জানান, যখন এএসপি আনিসুল করিমকে উপরে নিয়ে আসেন তখন তিনি বসা ছিলেন। আনিসুল করিমের হাতে একটি জুসের বোতল ছিলো। এসময় ৭ থেকে ৮ জন মিলে তার সঙ্গে কথা বলার একপর্যায়ে তাকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে টেনে হিঁচড়ে একটি ছোট কক্ষে নিয়ে যান।

তিনি বলেন, পুরো ঘটনাই আমি জানালা দিয়ে দেখছিলাম। যখন তাকে টেনে ওই রুমে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো তিনি যেতে চাচ্ছিলেন না। তাকে টেনে-ধাক্কা দিয়ে উপুড় করে ফেলে দেওয়া হলে তিনি চিৎকার করে বলছিলেন 'আল্লাহ আমাকে বাঁচান'। এর মধ্যে তার দুই হাত ওড়না দিয়ে পেছন দিকে বেঁধে ফেলা হয়।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এএসপি আনিসুল করিম কাউকে মারধর করবেন কেন, তিনিতো কোন সুযোগই পাননি। তিনি কোনো উশৃঙ্খল আচরণও করেননি। কারো সঙ্গে খারাপ আচরণ করেননি। তিনি শুধু বলছিলেন আপনারা আমাকে কেন নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি ভেতরে যেতে চাচ্ছিলেন না, তাই জোর করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়।

এএসপি আনিসুল করিমের ব্যাচমেট ডিবি পুলিশের কর্মকর্তা খন্দকার লেলিন বাংলানিউজকে বলেন, আনিসুল করিম অত্যন্ত মেধাবী ও ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি কয়েকদিন ধরে চুপচাপ থাকতেন এজন্য তাকে মানসিক চিকিৎসক দেখানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। কিন্তু ওই হাসপাতালে যেভাবে তাকে মারধর করা হলো এটা কোন চিকিৎসার উপায় হতে পারে না।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) হারুন অর রশীদ বলেন, তিনি কীভাবে এই ভূঁইফোড় হাসপাতালে গেলেন বা এর সঙ্গে কারা জড়িত ছিলো তাদের বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে। গ্রেফতারদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানা যাবে। এ ঘটনার সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।

নিহত আনিসুল করিম ৩১তম বিসিএসে পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান। সর্বশেষ তিনি বরিশাল মহানগর পুলিশে  ট্রাফিক বিভাগের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার বাড়ি গাজীপুরের কাপাসিয়ায়। তিনি এক সন্তানের জনক। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের ৩৩ ব্যাচের ছাত্র ছিলেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১০, ২০২০
পিএম/ওএইচ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।