ঢাকা: মানসিক চিকিৎসাসেবা নিতে যাওয়া সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আনিসুল করিমকে এলোতাথাড়ি মারধর করে হত্যার ঘটনায় রাজধানীর আদাবরের মাইন্ড এইড হাসপাতালের কর্মকাণ্ড নিয়ে নানান প্রশ্ন উঠেছে। আতঙ্কে ভর্তি থাকা ১২ জন রোগীই ছেড়েছেন হাসপাতাল।
মানসিক চিকিৎসা ও মাদকাসক্তি পুনর্বাসনের নামে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করলেও তাদের ছিল না কোনো অনুমোদন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা মাদকাদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কোনো অনুমতি ছাড়াই নিজেদের কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল প্রতিষ্ঠানটি। এমনকী হাসপাতালের সংশ্লিষ্টদের কেউ ডাক্তার ছিলেন না।
মঙ্গলবার (১০ নভেম্বর) আদাবরে অবস্থিত হাসপাতালটিতে সরেজমিনে দেখা যায়, আবাসিক এলাকার একটি ভবনে হাসপাতালের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল প্রতিষ্ঠানটি। বাইরে থেকে দেখে সহজে বোঝার উপায় নেই এটি কোনো হাসপাতাল। গেট দিয়ে প্রবেশ করলে প্রথমেই বাঁ পাশে ফার্মেসি, তারপর রিসিপশন। ডানপাশে ছোট সিঁড়ি হয়ে দ্বিতীয় তলায় উঠতেই চারটি কক্ষে রোগীদের চিকিৎসার জন্য বিছানা।
দ্বিতীয় তলার বারান্দায় বিশেষভাবে ছোট একটি কক্ষ তৈরি করা হয়েছে, যেখানে রোগীদের এনে প্রথমে রাখা হয়। যে কক্ষে হাসপাতালের স্টাফদের মারধরের কারণে কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্রাণ হারান এএসপি আনিসুল করিম।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সোমবার (৯ নভেম্বর) হাসপাতালটিতে ১২ জন চিকিৎসাধীন ছিলেন। তবে এ ঘটনার পর মঙ্গলবার (১০ নভেম্বর) ভোরে ১১ জন হাসপাতাল ছেড়ে চলে যান। আরিফুল হক চৌধুরী নামে একজন ছিলেন, পরে দুপুরের দিকে তিনিও হাসপাতাল ছাড়েন।
চিকিৎসা দেওয়ার নামে গত ২০ দিন ধরে হাসপাতালে আটকে রাখা হয়েছে বলে দাবি করেছেন কক্সবাজারের বাসিন্দা আরিফুল হক চৌধুরী। এই ২০ দিনে তাকে শুধু ভিটামিন ক্যাপসুল অ্যারিস্টোভিট এম ও গ্যাস্ট্রিকের ট্যাবলেট ওষুধ হিসেবে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া কোনো চিকিৎসাই দেওয়া হয়নি।
এই ২০ দিনে ওই ছোট কক্ষে রেখে ৪/৫ জনকে মারধর করতে বা আটকে রাখতে দেখেছেন তিনি। তার মতে, ছোট কক্ষে আটকে রেখে এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হয় যাতে তাদের কথামতো যে কোনো কিছু করতে বাধ্য হন চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা।
কক্সবাজারের একটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র থেকে তাকে মাইন্ড এইড হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, আমিও জানি না আমার সঙ্গে কেন এমন করা হচ্ছে। পরিবারের পক্ষ থেকে আমাকে কক্সবাজারে একটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে রাখা হয়। সেখান থেকে এই হাসপাতালের লোকজন গিয়ে আমাকে নিয়ে আসে।
আরিফুলকে কেন মানসিক হাসপাতালে রাখা হয়েছে এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় তার বোন নিলুফার ইয়াসমিনের সঙ্গে। তিনি প্রথমে তার ভাই আরিফুল ভর্তি আছে বলে স্বীকার করেন। কারণ জানতে চাইলে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
সংশ্লিষ্টদের ধারণা, পারিবারিক বিরোধের জেরে কাউকে চিকিৎসার নামে হাসপাতালটিতে আটকে রাখা হতে পারে।
হাসপাতালটি মানসিক চিকিৎসা ও মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র হিসেবে সেবা দেওয়ার কথা বললেও তারা এই সংশ্লিষ্ট কোনো অনুমোদন দেখাতে পারেনি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) হারুন অর রশীদ বলেন, তাদের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে কোনো অনুমোদন নেই। ভুইফোঁড় এ প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদে কোনো ডাক্তার নেই। তারা কীভাবে রোগী নিয়ে আসতো বা এই চক্রের সঙ্গে কারা জড়িত তাদের বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে।
এএসপি আনিসুল করিমের ঘটনাটি সুস্পষ্ট হত্যাকাণ্ড। এ ঘটনার সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক, সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে বলেও জানান তিনি।
এর আগে এ হাসপাতালে আর কাউকে নির্যাতন করা হয়েছিলো কিনা জানতে চাইলে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, কেউ আমাদের কাছে অভিযোগ করেনি। তবে বিষয়গুলো আমরা খতিয়ে দেখছি।
এএসপি আনিসুল করিমকে মারধর করে হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর হাসপাতালটি পরিরিদর্শন করেছেন মাদকদ্রব্য নিয়য়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একটি প্রতিনিধিদল।
এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মেহেদী হাসান বলেন, আমরা হাসপাতালটির সঙ্গে আমাদের কোনো বিষয়ে সংশ্লিষ্টতা ছিল কিনা তা যাচাই করতে সেখানে গিয়েছি। তারা কীভাবে হাসপাতালটি পরিচালনা করছিল, এ বিষয়টি যাচাই করে দেখা হচ্ছে।
এএসপি আনিসুল করিমকে চিকিৎসার নামে এভাবে মারধরের বিষয়ে পাবনা মানসিক হাসপাতালের মনরোগ বিশেষজ্ঞ মকবুল হোসেন পাশা বাংলানিউজকে বলেন, মানসিক চিকিৎসার নামে রোগীর সঙ্গে এ ধরনের ঘৃণ্য আচরণ কখনোই করতে পারেন না। মেন্টাল অ্যাক্ট এটাকে কোনোভাবেই সাপোর্ট করে না। মাইন্ড এইড হাসপাতাল যেটা করেছে এটা অত্যন্ত ঘৃণ্যতম কাজ।
বাংলাদেশ সময়: ১৯১৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১০, ২০২০
পিএম/এএ