বাগেরহাট: বলেশ্বর নদীর তীরে বাড়ি। ছোটবেলা থেকে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে বড় হয়েছি।
আনুমানিক রাত ১১টার দিকে হঠাৎ বাতাসের বেগ বাড়লো। সবাইকে বললাম দ্রুত ঘর থেকে বের হও। আমিও মুহূর্তের মধ্যে ঘর থেকে বের হয়ে পুরাতন বেড়িবাঁধের মধ্যে থাকা নুর মোহাম্মাদের বাড়িতে গিয়ে উঠি। মাত্র ৫ মিনিটের ব্যবধানে কয়েক ফুট উচ্চতার পানির স্রোত আসে। নুর মোহাম্মাদের ঘরের সব দরজা খোলা ছিল। তার ঘরের মধ্যে যখন চার ফুট পানি প্রবেশ করে তখন সাঁতরে বের হয়ে যাই। পানির স্রোতে যেতে খুব কষ্ট হচ্ছিল তারপরও অনেক কষ্টে পাশের বাড়ির আব্দুল মল্লিকের বাড়ির একটি গাছে উঠে জীবন রক্ষা করেছিলাম। সবকিছুই হয়েছিল বড় অল্প সময়ের মধ্যে।
ফজরের আজানের পরে আমি গাছ থেকে নেমে বাড়িতে এসে দেখি আমাদের ঘরের কোনো চিহ্ন নেই। ঘরে থাকা বাবা (মো. লাল মিয়া হাওলাদার), মা (তাসলিশা বেগম), ছোট দুই ভাই (তহিদ ও জাহিদ) ও এক বোনকে (লাবনি) আর খুঁজে পেলাম না। পরবর্তীকালে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুজির পর ধান ক্ষেতের মধ্যে বাবা, মা ও এক ভাইয়ের মরদেহ পাই। আর এখনো পর্যন্ত বাকি ভাই-বোনকে খুঁজে পাইনি।
কথাগুলো বলছিলেন ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সিডরে বাবা-মাসহ পরিবারের পাঁচ সদস্যকে হারানো শরণখোলা উপজেলার উত্তর সাউথখালী গ্রামের লাল মিয়া হাওলাদারের ছেলে মো. বাদল হাওলাদার।
সিডরের ক্ষত কাটিয়ে উঠলেও দুঃসহ স্মৃতি এখনো কাঁদায় বাদলকে। মনে পড়লেই আঁতকে ওঠেন স্বজন হারানোর বেদনায়। বাদলের দাবি সাউথখালী ইউনিয়নকে রক্ষার জন্য নদীশাসন করে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করতে হবে। তা না হলে আবারও আমাদের হারাতে হবে বাপ-দাদার পৈত্রিক ভিটা ও প্রাণের সন্তানদের।
সিডরে পরিবারের সাত সদস্য হারানো শরণখোলা উপজেলার উত্তর সাউথখালী গ্রামের মৃত আব্দুর রহমানের ছেলে আল আমিন খান বলেন, সন্ধ্যার দিকে মা এক ধরনের জোর করেই তাফালবাড়ি বাজারে পাঠান কিছু জিনিসপত্র কিনতে। কিন্তু তাফালবাড়ি বাজারে যাওয়ার পরে বৃষ্টি বাড়লে আমি আর বাড়ি আসিনি। যখন বাতাসের গতি বেড়ে যায় তখন আমি তাফালবাড়ি বাজার সংলগ্ন একটি ভবনে আশ্রয় নিয়েছিলাম। রাত আনুমানিক ৩টার দিকে বাতাস কমে গেলে রাস্তায় বের হয়ে দেখি গাছ আর গাছ। হাঁটার কোনো উপায় নেই। অনেক কষ্ট করে বাড়িতে গিয়ে আমাদের ঘরের কোনো চিহ্নই পেলাম না। বাড়িতে থাকা বাবা (আব্দুর রহমান), মা (সুপিয়া বেগম), ফুফু (হায়াতুননেছা) ফুফাতো বোন (হনুফা ও ফাতেমা), ভাগ্নে (আবু হানিফ) এবং নানিকে (নুর বানু) আর খুঁজে পেলাম না। পরের দিন ধান ক্ষেত, মানুষের বাগানসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে মরদেহ এনে কবর দিয়েছিলাম।
সব হারানোর পরেও আশা ছিল বেড়িবাঁধ হলে বাবার যেটুকু জমি-জমা আছে তাই নিয়ে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকব। কিন্তু সিডরের পরেও প্রতিবছর বৃষ্টির মৌসুমে এলাকার অনেকেই জমি হারিয়েছে বলেশ্বর নদীতে। আমরা ত্রাণ চাইনা, আমাদের এলাকার মানুষের জানমাল রক্ষার জন্য টেকসই বেড়িবাঁধ চাই।
আল আমিন আরও বলেন, সিডরের সময় আমার বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর। তখন থেকেই প্রতিবছর এই দিনে দোয়া মাহফিলের আায়োজন করি। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই, দয়া ভিক্ষা চাই যাতে সিডরের মতো কোনো বড় দুর্যোগে এভাবে আমাদের স্বজনদের হারাতে না হয়।
শুধু আল আমিন এবং বাদল হাওলাদার নয় এমন স্মৃতি রয়েছে শরণখোলা উপজেলার অনেকেরই। ২০১৭ সালের পরে শরণখোলাসহ সিডর বিধ্বস্ত বাগেরহাটের মানুষের উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা কাজ করেছে। মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থারও পরিবর্তন হয়েছে। তবে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের মূল যে দাবি ছিল তা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি।
এদিকে যেটুকু বেড়িবাঁধ নির্মাণ হয়েছে, তাতেও রয়েছে সমস্যা। পানি নিষ্কাশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় শরণখোলা উপজেলা সদরের রায়েন্দা এলাকায় সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় এই বেড়িবাঁধের কারণে। এছাড়া সাউথখালী ইউনিয়নের গাবতলা থেকে বগী পর্যন্ত সোয়া দুই কিলোমিটার বাঁধের নির্মাণকাজ এখনও শেষ হয়নি। প্রতিবছরই এই জায়গা থেকে লোকালয় প্লাবিত হয়। প্রাণহানি না ঘটলেও প্রচুর পরিমাণ সম্পদের ক্ষতি হয় স্থানীয়দের।
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর রাতে ঘূর্ণিঝড় সিডর আঘাত হেনেছিল বাগেরহাটসহ দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি জেলায়। এতে সরকারি হিসেবে এই ঝড়ে জেলার ৯০৮ জন মানুষের প্রাণহানি হয়েছিল। তবে স্থানীয়দের দাবি মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি ছিল। সিডরে গাছ পরে বাগেরহাটের সব রাস্তা ঘাট বন্ধ ছিল। প্রায় এক মাস সময় লেগেছিল জেলার সব রাস্তা স্বাভাবিক করতে। তবে মহাসড়ক ও আঞ্চলিক মহাসড়কগুলো তিনদিনের মধ্যে স্বাভাবিক হয়েছিল। কয়েকশ কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়েছিল বাগেরহাটবাসীর।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০২০
আরএ