ঢাকা: ঢাকা থেকে ১৮ কোটি মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ হতে পারে না বলে মনে করেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা এবং ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তার মতে, সবকিছু বিকেন্দ্রীকরণ না হলে সব শ্রেণীর মানুষ স্বাস্থ্যসেবা পাবে না।
নানা নেতিবাচক কারণে সম্প্রতি বারবার আলোচনায় উঠে এসেছে দেশের স্বাস্থ্যখাতের করুণ চিত্র। একের পর এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে দেশের স্বাস্থ্য খাতে। কোনো হাসপাতালে অভিযান চালালেই দেখা মিলছে নানা অনিয়ম। সর্বশেষ রাজধানীর একটি মানসিক হাসপাতালে কর্মীদের নির্যাতনে মৃত্যু হয়েছে এক পুলিশ কর্মকর্তার।
স্বাস্থ্যখাতে কেন এমন ঘটনা ঘটছে, এর প্রতিকারসহ নানা বিষয়ে বাংলানিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তার সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো।
বাংলানিউজ: হাসপাতালে মানুষ চিকিৎসা গ্রহণ করে সুস্থ হতে যায়, সেই হাসপাতালে পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যার ঘটনা কীভাবে দেখছেন?
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী: বর্তমানে পিটিয়ে মানুষ মেরে ফেলাই চিকিৎসায় পরিণত হয়েছে। দেশে যত নৈরাজ্য থাকবে ততই দেশ শাসন সহজ হবে। চিকিৎসা গ্রহণ করতে গিয়ে পিটানো এই অনাচারকেই তারা চিকিৎসায় পরিণত করেছে।
সরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররা বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা প্রদান করেন। সরকারি ডাক্তাররা কখনো বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে পারবেন না। বিচারপতিরা যদি আজকে ব্যক্তিগত মামলা-মোকদ্দমা করেন তাহলে কি সঠিক বিচার পাওয়া যাবে? ঠিক একই বিষয় স্বাস্থ্য খাতের জন্য প্রযোজ্য।
বেসরকারি হাসপাতালগুলো রেজিস্ট্রেশন করে তার তালিকা প্রতিটা এলাকায় টাঙিয়ে দেওয়া যেতে পারে, এই পাঁচটা হাসপাতাল সরকার অনুমোদিত। এর বাইরে অন্য হাসপাতালগুলো অবৈধ এবং বেআইনি। এসব হাসপাতালে কেউ চিকিৎসা গ্রহণ করে ক্ষতিগ্রস্ত বা মৃত্যুবরণ করলে তার দায়িত্ব সরকার নেবে না। কোন অপারেশনে কত টাকা খরচ হবে এটা নির্ধারণ করে দেওয়া কি খুব কঠিন কাজ? এটা করলে সেই তালিকার বাইরে কোন হাসপাতাল থাকলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালিয়ে খুব সহজেই সেগুলো বন্ধ করে দিতে পারে। এটা খুব বেশি কঠিন কাজ নয়। তাই এমন অন্যায় এবং অন্যায্য কাজের জন্য সরকার দায়ী। বাংলানিউজ: কোন কোন ক্ষেত্রে সরকার দায়ী বা ভুল করছে বলে মনে করেন?
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী: বর্তমান সময়ে দেখেন, সরকার চাচ্ছে বলেই ওষুধের দাম বাড়ছে। করোনার ভ্যাকসিনের দাম ভারতে ৩ ডলার, অথচ আমাদেরকে দিতে হবে পাঁচ ডলার। সরকারের নিজস্ব অ্যাসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড (ইডিসিএল) রয়েছে। সেই কোম্পানির মাধ্যমে ভারত থেকে করোনার ভ্যাকসিন আমদানি করলে আমাদেরকে এই অতিরিক্ত ২ ডলার দিতে হতো না।
১৯৮২ সালে আমরা ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণে যে ওষুধ নীতি তৈরি করেছিলাম। এই নীতির ফলে ১১৭টা ওষুধের মূল্য কোনো সময় বাড়ে না। বাকি সব ওষুধের দাম হু হু করে বেড়েই চলছে। সরকার চায় বলেইতো এমন হচ্ছে।
বাংলানিউজ: কোনো হাসপাতালে ঘটনা ঘটার পর আমরা জানতে পারি সেগুলোর বৈধতা ও অনিয়ম প্রসঙ্গে। তাহলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে দায়িত্বরতদের ভূমিকা সম্পর্কে কী বলবেন?
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী: এসব কথা বললেই স্বাস্থ্য খাতের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা প্রথমেই বলবেন, আমাদের জনবল নেই। সেই জন্যই আমি বারবার পরিষ্কার সহজ-সরলভাবে বলছি, এসব অন্যায়, অবিচার, অনিয়ম এবং ভুলের জন্য সরকার দায়ী। প্রতিটা সরকার এমন অন্যায় অবিচার চায় বলেই হয়। দেখেন এক দিকে আমাদের প্রধানমন্ত্রী দাবি করছেন সবাইকে বিনামূল্যে করোনার ভ্যাকসিন দিতে হবে। আবার অন্যদিকে তিনি বেক্সিমকোর সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করছেন। প্রতিটা ভ্যাকসিনে বেক্সিমকো ২ ডলার লাভ করবে। তাহলে তার কথা দু'রকম হয়ে যাচ্ছে।
বাংলানিউজ: স্বাস্থ্য খাতের বর্তমান পরিস্থিতি উত্তরণের উপায় কী বলে মনে করেন।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী: ঐযে নূর হোসেনের কথা 'গণতন্ত্র মুক্তি পাক'। দেশে পরিবর্তন প্রয়োজন। গণতন্ত্র মুক্তি পেলে এসবের পরিবর্তন আসবে। পরিবর্তন ছাড়া কোন কিছু সম্ভব না। আমাদের রাজনীতি ঠিক হতে হবে। রাজনীতিতে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রেও জবাবদিহিতা থাকতে হবে। তাহলেই পরিবর্তন হবে।
বাংলানিউজ: আপনি পরিবর্তনের কথা বলছেন, কোন ক্ষেত্রে কেমন পরিবর্তন প্রয়োজন বলে মনে করেন?
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী: ঢাকার শাসন এবং ইসলামাবাদের শাসনের কোন তফাৎ নেই। স্বাধীনতার পূর্বে আমাদেরকে যেমন কোন কাজের জন্য ইসলামাবাদ যেতে হতো এখনো ঠিক তেমনি ঢাকায় আসতে হয়। ১৮ কোটি মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ হয় ঢাকা থেকে, এটা চলতে পারে না।
তাই যারা শেখ সাহেবের (জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) পক্ষের লোক এবং যারা পক্ষের না, সবাইকে শেখ সাহেবের ডিসেন্ট্রালাইজেসন (বিকেন্দ্রীকরণ) নীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন। শেখ সাহেবের ডিসেন্ট্রালাইজেসন নীতির অনুসারে ৬৪টা না হোক, অন্তত ১৮ কোটি লোকের জন্য ১৮টা প্রদেশ হওয়া উচিত। শিক্ষিত মানুষরাও বিভাগ বিভাগ করতে থাকে। ১৯৩৪ সালে ফ্লাউড কমিশন বিভাগ সম্বন্ধে বলেছেন, এটা অপ্রয়োজনীয়। বিভাগ বাড়িয়ে আমলাতান্ত্রিকতা বাড়ানো হচ্ছে। আর প্রদেশ মানে হচ্ছে স্বনির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসন।
সরকার স্বাস্থ্যখাতে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করছে। কিন্তু একটা ইউনিয়নে যেখানে ৫০ থেকে ৭০ হাজার লোক বসবাস করে, সেখানে দুজন ডাক্তার থাকে না। যতদিন ঢাকা থেকে সেখানে নিয়োগ হবে, ততদিন সেখানে ডাক্তার থাকবে না। ডাক্তাররা যদি জেলা বা প্রদেশ থেকে নিয়োগ পেতেন তাহলে ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে থাকতে বাধ্য হতেন এবং জনগণও স্বাস্থ্যসেবা পেত। তাই মৌলিক পরিবর্তন না করলে হবে না।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪২ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৭, ২০২০
আরকেআর/এজে