সাভার (ঢাকা): অস্ত্র মহড়া, মাদক সেবন-বিক্রি, চাঁদাবাজি, মারামারি, খুন ও ধর্ষণের মত বড় বড় ঘটনা ঘটাচ্ছে ১৪-১৫ বছর বয়সী কিশোরেরা। এক কথায় সমাজ ব্যবস্থাকে কলুষিত করছে তারা।
আধিপত্য বিস্তার ও ত্রাস সৃষ্টির জন্য গ্যাং তৈরি করে লোমহর্ষক সব অপকর্ম করে যাচ্ছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। তাদের উদ্দেশ্য ও ভাবনা পুরোই আলাদা। ফেসবুক গ্রুপ, বাহারি পোশাক, মোটরসাইকেল নিয়ে মহড়ার মাধ্যমে এলাকায় নিজেদের আধিপত্র বিস্তার করে তারা। কিশোরদের উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে সমাজের মানুষ।
স্কুলসহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কিশোরদের গ্যাং কালচারের বিভিন্ন রূপ প্রকাশ পাচ্ছে। অলস বসে থাকায় এ সময়ে যেন কিশোর-তরুণদের অপরাধ প্রবণতা বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি ব্যাপক আলোচনার কেন্দ্র বিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে এ ‘কিশোর গ্যাং’।
ঢাকা জেলার সাভার মডেল থানা ও আশুলিয়া থানায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ দুই থানায় তালিকাভুক্ত কোনো কিশোর অপরাধী নেই বললেই চলে।
তবে সম্প্রতি প্রতিনিয়ত এ অঞ্চলগুলোতে ধর্ষণ, খুন ও অপহরণের মত নানা অপকর্মের মূলে রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা।
সাভারে যেসব অপকর্ম ঘটিয়েছে কিশোর গ্যাং সদস্যরা:
সাভারের আনন্দপুর থেকে অপহরণ করা হয় কিশোর হৃদয়কে। পরে গত ৯ অক্টোবর তাকে উদ্ধারসহ অপহরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত মুসা কাজী, জাহিদ হাসান ও আশিক হোসেন নামে তিন কিশোরকে আটক করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-৪। আটক তিনজনই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য।
গত ৩০ আগস্ট দুই বান্ধবী বেড়াতে গেলে 'প্রিন্স' গ্যাংয়ের প্রধান প্রিন্স সারুফ, আল আমিন, ডায়মন্ড আল আমিন, জাকির হোসেন, রেদওয়ান, বাদশা, জিহাদ, আল আমিন, বাটা আল আমিন, শাকিলসহ অজ্ঞাতনামা আরও চার থেকে পাঁচজন কিশোর মিলে তাদের ধর্ষণ করে এবং সে দৃশ্য ভিডিও ধারণ করে৷ পরে ভিডিওটি গত ৬ অক্টোবরের দিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তাদের ভেতর সারুফ, জাকির ও ডায়মন্ড আল আমিনকে গত ০৭ অক্টোবর গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে ভুক্তভোগীদের একজনের বড় বোন।
গত ২০ সেপ্টেম্বর রাতে সাভারে হাসপাতাল থেকে ফেরার পথে নিলা রায়কে (১৪) ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে কিশোর গ্যাং সদস্য মিজানুর। ওই ঘটনায় নীলার বাবা নারায়ণ রায় ২১ সেপ্টেম্বর রাতে মিজানসহ অজ্ঞাতনামা আরও কয়েকজনকে আসামি করে সাভার থানায় মামলা করেন।
২০১৯ সালের ১৬ অক্টোবর সাভার পৌর এলাকার কাতলাপুর মহল্লায় চাঁদা না দেওয়ায় 'শুভ গ্যাং' সদস্যদের হাতে হামলার শিকার হন কামরুল ইসলাম। পরে সাভার মডেল থানায় শুভ, মনির, সুজন, সাকিব, বুলেট ওরফে আনান, সাগর, ফারুক, মাহাবুব, জামিল, রেজাউলসহ অজ্ঞাতনামা আরও কয়েকজনের নামে অভিযোগ দায়ের করেন কামরুল৷
২০১৯ সালের ১০ সেপ্টেম্বর দুপুরে সাভারের কাউন্দিয়ার নদী পারাপারের সময় বেসরকারি ইউনিভার্সিটির ছাত্র নাহিদ হাসান মিলুকে ছুরিকাঘাতে হত্যার চেষ্টা করে কিশোর গ্যাং সদস্যরা। ঘটনায় জড়িত কিশোর গ্যাংয়ের চার সদস্য কাওছার, নিবিড়, ইমরান ও শফিউলকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
২০১৯ সালের ১ মার্চ সন্ধ্যায় সাভার সিআরপি এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের ছুরিকাঘাতে মো. সোহাগ (১৬) নামে এক অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য মিঠুকে আটক করে পুলিশ।
অনুসন্ধানে সাভারে 'কিশোর গ্যাং' এর সংখ্যা:
সাভারের সব চেয়ে বড় কিশোর গ্যাং হচ্ছে জাহাঙ্গীরনগর এলাকার 'ব্রাদাহুড’ গ্যাং। গ্যাংয়ের সক্রিয় সদস্য প্রায় ১০ জন। তাদের মধ্যে ইশতিয়াক আহমেদ রুদ্র, আরিয়ান তাহসিন তূর্ণ, সালমান হোসেন রাতিন, রাকিব হোসেন, শারাফ শাফিন ইমন, মোতাহের হোসেন তাসিম অন্যতম।
'ডিফারেন্ট বয়েজ' নামে আরেকটি কিশোর গ্যাং রয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে কলাবাগান এলাকায়। এ গ্রুপে আবু সুফিয়ান আকাশ, কামরুল হাসান রনি ও সবুজ ইসলাম বাবুসহ রয়েছে অনেক কিশোর।
সাভার পৌর এলাকার আট নম্বর ওয়ার্ডে কিশোর সায়েম রহমান সাদাফ ওরফে (মুন্সি সাদাফ) নামে পরিচিত। তার গ্যাংয়ে প্রায় ২০ জন কিশোর রয়েছে।
এছাড়া সাভারের রেডিও কলোনি, আশুলিয়ার গাজীর চট, ভাদাইল, কাউন্দিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে ছোটো বড় কিশোর গ্যাং রয়েছে।
স্থানীয় জনগণ ও সচেতন ব্যক্তিরা যা বলছেন:
সাভার পৌর এলাকার বাসিন্দা মেহেদি হাসান বাংলানিউজকে জানান, সাভার পৌর এলাকার বিভিন্ন স্থানে মাদকের জমজমাট বেচাকেনার পাশাপাশি বিভিন্ন খালি বাউন্ডারিতে নিয়মিত মাদক সেবন করে থাকে এলাকার উঠতি বয়সী কিশোর, যুবকসহ অনেকেই। পরিত্যক্ত বাউন্ডারি ও খোলা মাঠগুলো সন্ধ্যার পরই কিশোর গ্যাং সদস্যদের আড্ডাস্থলে পরিণত হয়।
কিশোর গ্যাং এর সদস্য কর্তৃিক দুই বান্ধবী গণধর্ষণের এলাকা ভাদাইলে গিয়ে কথা হয় ব্যবসায়ী রিফাতের সাথে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ছোটো ছোটো ছেলেরা যেভাবে অস্ত্র ও মোটরসাইকেল নিয়ে চলাচল করে, তাতে তাদের সঙ্গে কেউ কথা বলতে যায় না। তাদের কারো সঙ্গে একটু কথা কাটাকাটি হলেই সবাই ঝাঁক বেধে চলে আসে। এর জন্য ভয়ে কেউ কথা বলতে চায় না। এসব কিশোরকে দ্রুত সামলানো না গেলে আরও বড় বড় অপকর্ম করে ফেলবে।
আশুলিয়া থানা সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি লায়ন ইমাম বাংলানিউজকে বলেন, আমরা রাজনৈতিক নেতারা যেন ১৪-১৬ বয়সের ছেলেদের নিয়ে মিটিং-মিছিল না করি। নেতাদের স্বার্থে যদি কিশোরদের ব্যবহার না করা হয়, তাহলে কিশোর গ্যাং তৈরি হবে না। আজ ছোটো ছোটো ছেলেদের পরিচয় জিজ্ঞেস করা হলে তারা বিভিন্ন ভাইয়ের পারিচয় দেয়। বর্তমানে যে শিশুদের কাছে কলম কাগজ থাকার কথা, তাদের হাতে এখন বন্দুক, নেশা জাতীয় দ্রব্য। আমি মনে করি, সামাজিকভাবে ও রাজনৈতিকভাবে উদ্যোগ নেওয়া হলে কিশোরদের গ্যাং নির্মূল সম্ভব।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কী বলছেন:
সাভার উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা মোহাম্মদ শিবলীজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে বর্তমানে আমার এখানে (কার্যালয়) তিনজন কিশোর রয়েছে। যারা বিভিন্ন অপরাধ করে এলেও এখন আস্তে আস্তে স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে। স্বাভাবিক জীবনে পুরোপুরি ফিরলে তাদের শর্তসাপেক্ষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
করোনাকে বর্তমানে কিশোর অপরাধগুলোর প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বর্তমানে করোনার কারণে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। উঠতি বয়সের ছেলেরা এমনিতে চঞ্চল হয়ে থাকে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার সুযোগে তারা অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে। সাভার ও আশুলিয়া শিল্প এলাকা এখানে পরিবারের কর্তা ব্যক্তিরা কর্মস্থলে চলে গেলে কিশোররা আরও সুযোগ পায়। কিশোর অপরাধকে রুখতে সব দিক থেকেই আমাদের এগিয়ে আসতে হবে।
কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়টি নিয়ে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মারুফ হোসেন সরদার বাংলানিউজকে বলেন, সাভার ও আশুলিয়ায় যে দু’টি বড় ঘটনা ঘটেছে, সে দু’টি ঘটনা তদন্ত করে আসামিদের গ্রেফতার করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১০১৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ২২, ২০২০
এসআই