রাজশাহী: মায়ের কোলে শিশুর পৃথিবী নিরাপদ হলেও কোনো কোনো মায়ের গর্ভেই শিশু অনিরাপদ। মায়ের গর্ভে থাকা শিশুর আকার-আকৃতি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে হয়ে যায় অন্যের কেনা সম্পদ।
আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, এমনই ঘটনা ঘটছে রাজশাহীতে। নগরীতে এখন গর্ভে থাকতেই সন্তান বেচাকেনা চলছে! শিশুর দাম নির্ধারণ হচ্ছে লিঙ্গ ভেদে। মেয়ে হলে কম আর ছেলে হলে বেশি দাম। আবার গয়ের রং ও স্বাস্থ্য ভেদেও দাম কম-বেশি হয়। বিক্রি হয়ে যাওয়া শিশুর মধ্যে কিছু বিদেশে পাচার হয়ে যায়, কখনো আবার পালক হিসেবেই কিনে নেয় অনেকে। এগুলো এত গোপনে হয় যে, অনেক ক্ষেত্রে মা নিজেও সন্তানের মুখ দেখার সুযোগ পান না। অনেকের কাছে এটা পেশাও।
রাজশাহী রেলস্টেশনের পাশেই গণসৌচাগারের পেছনের ফাঁকা জায়গায় এক কিশোরী সারা দিন ঠায় বসে থাকেন। তার যেন কোনো ব্যস্ততা নেই, কোথাও যাওয়ার নেই। তার ‘স্থায়ী ঠিকানা’ এটাই। বয়স ১৮ পার হয়নি। গর্ভে বেড়ে উঠছে শিশু।
পেটের সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই ১০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়েছেন ওই কিশোরী। সন্তান জন্মের পর তিনি ওই টাকা পাবেন। রাজশাহী মহানগরীর এক নিঃসন্তান দম্পতি ওই শিশুটিকে কিনেছে। সন্তান জন্মের আগ পর্যন্ত তারা সন্তান সম্ভবা কিশোরীকে দেখাশোনা করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যারা গর্ভে সন্তান ধারণ করে বিক্রি করছে তারা ভ্রাম্যমাণ পতিতা হিসেবে কাজ করেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গর্ভের সন্তানের পিতৃপরিচয় থাকে না। সন্তান মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায় নামমাত্র মূল্যে বিক্রি হয়ে যায়। সাধারণত নিঃসন্তান দম্পতিরা এভাবে শিশু কিনেন। বিক্রি হয়ে যাওয়া শিশুদের শেষ পরিণতি কী হচ্ছে তা কেউই খবর রাখেন না।
রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় শাহেদা নাসরিন (ছদ্মনাম) নামের এক কিশোরী সঙ্গে কথা হয়। তিনি বাংলানিউজকে জানান, তার বয়স এখনো ১৮ বছর পার হয়নি। তিন বছর আগে তার বিয়ে হয়েছিলো। কিন্তু ছয় মাস না যেতেই স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়। তার বর্তমান পেশা তিনি যৌনকর্মী। সেও একইভাবে গত রোজার ঈদের আগে তার শিশুকে ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। রাজশাহীর ভদ্রা এলাকার কামাল নামে এক মোটর গেরেজ কর্মী শিশুটিকে কিনে নেন।
নিজের গর্ভে ধারণ করা সন্তান নিজেই বিক্রি করে দিলেন, নিজের কাছে একটুও খারাপ লাগেনি? এই প্রশ্নে তিনি বলেন, লালন-পালন করার সমস্যা থাকাতে বিক্রি করে দিয়েছেন। আগে এক সময় খারাপ লাগতো। এখন আর লাগে না।
চলতি বছরের গত মে মাসে সন্তান বিক্রি করেছিলেন আরেক কিশোরী। মঙ্গলবার (১ ডিসেম্বর) সেই কিশোরীর সঙ্গে ভদ্রা রেল বস্তিতে কথা হলে তিনি জানান, তার স্বামী আরেকটি বিয়ে করার সময় তাকে তালাক দেন।
রাজশাহী রেলওয়েস্টেশন ঘিরে তিনি সংসার পেতে বসেছেন। খদ্দের প্রতি তার আয় ১০০ টাকা। জন্মের পরপর তিনি নিজের শিশুদের বিক্রি করেছিলেন। কে তার গর্ভের শিশুর বাবা তা জানেন না। তাই গর্ভে থাকতেই তার সন্তানকে বিক্রি করে দিয়েছেন। কোনো নিঃসন্তান দম্পতি যদি তাকে অনুরোধ করে তবে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকার মধ্যে শিশু জোগাড় করে দেন।
আরও জানা যায়, গর্ভের সন্তান কেনাবেচায় রাজশাহী মহানগরীতে এরই মধ্যে একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। যাদের অনেকেরই বয়স ১৮ বছরের নিচে। সীমা নামে এক নারী এসব শিশু বেচাকেনার সমন্বয় করে। সে তার নিজের সন্তানকেও বিক্রি করেছে। সম্প্রতি পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে।
গত শুক্রবার (২৭ নভেম্বর) সীমার মাধ্যমে মহানগরীর ভদ্রা এলাকার শ্যামলী নামে এক নারী তার ৫ মাসের শিশুকে বিক্রি করেন মাত্র ১২ হাজার টাকায়। ওই শিশুকে কিনে নেন জান্নাতি নামে এক গার্মেন্টসকর্মী। বিক্রির পর থেকে শিশুর সেই মা শ্যামলীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
টাকার বিনিময়ে কেনা এই শিশু আদৌ শ্যামলীর, নাকি চুরি করা তা নিয়ে সংশয় দেখা দেখা দিলে ওই দম্পতি আইনের শরণাপন্ন হন।
বিষয়টি জানাজানির পর গত শনিবার (২৮ নভেম্বর) রাজশাহী রেলওয়ে থানার পুলিশ জান্নাতি, তার স্বামী, খালা রোকেয়া ও মধ্যস্থতাকারী সীমাকে আটক করে। পরে তাদের বিরুদ্ধে অপহারণ মামলা দায়ের করে আদালতে হাজির করলে তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
জানতে চাইলে রাজশাহী রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ শাহ কামাল বলেন, গ্রেফতারকৃতরা শিশুটিকে কার কাছ থেকে কিনেছে তা সঠিকভাবে বলতে পারেননি। শিশুর প্রকৃত মা কে তারা জানাতে বা দেখাতে পারেননি। এ কারণে তাদের বিরুদ্ধে শিশু অপহরণ মামলা দায়ের করা হয়েছে। আদালত তাদের কারাগারে পাঠিয়েছেন। আর উদ্ধার করা ওই শিশুকে ছোটমনি নিবাসে পাঠানো হয়েছে।
বর্তমানে এই সিন্ডিকেটের খোঁজে তারা মাঠে নেমেছেন বলেও জানান জিআরপি থানার এই কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ সময়: ০০২৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০২, ২০২০
এসএস/এইচএমএস