ঢাকা: রাজধানীর পল্লবীতে মাদক ও জুয়াসহ নানা অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে সুমন বাহিনী। তারা এরইমধ্যে এলাকায় এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে।
নভেম্বরেই পল্লবী থানার তিন মামলার আসামি সুমন বাহিনীর প্রধান মো. সুমন ওরফে নেতা সুমন। তিনি মোবাইলসহ বিভিন্ন মাধ্যমে পল্লবীর বাসিন্দাদের হুমকি দিয়ে হামলা চালিয়ে যাচ্ছেন।
মামলা হলেও থেমে নেই তার অপকর্ম। ভুক্তভোগীরা দিন কাটাচ্ছেন আতঙ্কের মধ্যে।
সম্প্রতি জানা গেছে, সুমনের নামে নভেম্বরেই তিনটি মামলা হয়েছে পল্লবী থানায়। দুটি মামলার প্রধান আসামি ও একটি মামলায় পঞ্চম আসামি সুমন।
গত ৪ নভেম্বর পল্লবী থানায় সুমন বাহিনীর ৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন (মামলা নং-০৯) শান্তা আক্তার নামের এক নারী। মাদক বিক্রি করার প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তাকে হুমকি দেওয়া হয়। এক পর্যায়ে তার ওপর হামলা চালিয়ে এলোপাতাড়ি কোপানো হয়। এতে তার ডান হাতের দুটি আঙুল কেটে পড়ে যায়। কব্জি কেটে যায়, ৩টি রগ কেটে যায়। বাম পায়ের ওপরে নয়টি কোপ দেওয়া হয়। তাকে পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
এই মামলার আসামিরা হলেন- মো. আপন আহমেদ, মো. সিফাত (২০), রনি (৩৪), মো. জামান (৩৫), মো. সুমন (৩২), লিজা (২২), রাজন (৩৬), সাগর (২৬) ও মো. দুলাল (৩৫)।
ভুক্তভোগী শান্তা আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, “আমার ওপর হামলাকারী আসামিরা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। জানতে পেরেছি ওরা আরও দুই জনকে কুপিয়েছে। শুক্রবার (৩০ অক্টোবর) বিকালে টাকা ধার দেওয়ার কথা বলে বাবার বাসা থেকে ডেকে এনে আমার ওপর হামলা করা হয়।
শান্তার অভিযোগ সুমনের নামে প্রথমে মামলা নিতে চায়নি থানা।
গত মঙ্গলবার (২৪ নভেম্বর) বিকালে মিরপুর ১২ নম্বর সিরামিক রোডে জমির বিরোধ নিয়ে চোখে মরিচের গুঁড়া ছিটিয়ে কুপিয়ে এক যুবককে জখম করে সন্ত্রাসীরা।
আহত শাহিনুদ্দিনের মা মোছা. আকলিমা বাদী হয়ে এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার (২৬ নভেম্বর) মামলা দায়ের করেন। এ ঘটনায় পল্লবী থানায় ১৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
মামলার বাদী আকলিমা বলেন, ঘটনার দিন সন্ধ্যায় আমার ছেলে মিরপুর ১২ নম্বর উত্তর কালশীর সিরামিক রোড দিয়ে বাসায় ফিরছিল। এমন সময় আগে থেকে ওৎ পেতে থাকা ডেভেলপার কোম্পানির কর্মচারী সুমন ও তাহেরের নেতৃত্বে কয়েকজন সন্ত্রাসী তার ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। চোখে মরিচের গুঁড়া ছিটিয়ে দেয় এবং কুপিয়ে মাথার চারপাশ জখম করে।
আকলিমার অভিযোগ, তার ছেলেকে হত্যার উদ্দেশ্যেই এ হামলা চালানো হয়েছে। তাদের সম্পত্তি দখলে নেওয়ার জন্য ডেভলপার কোম্পানির লোকজন এটা করেছে। এর আগেও তার ছেলের ওপর বহুবার তারা হামলা করেছে। থানায় একাধিকবার জিডি এবং মামলাও করেছেন তিনি।
তিনি জানান, তার ছেলের ওপরে হামলায় টিটু, দীপু, রাজন, কাল্লু, লিটন, আবুল, ন্যাটা সুমন, ইয়াবা বাবু, জামাল, হাবিব, রনি সবাই জড়িত।
এছাড়া শনিবার (২৮ নভেম্বর) মো. সুমনকে প্রধান আসামি করে ৬ জনের বিরুদ্ধে পল্লবী থানায় মামলা (মামলা নং-৮৭,) করেন মো. বাবু নামের এক ব্যক্তি।
মামলার এজাহারে বাবু বলেন, বৃহস্পতিবার (২৬ নভেম্বর) সকাল সাড়ে ১১টায় তিনি সিরামিক রোডের চান্দার টেকের বাইরে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়েছিলেন। এ সময় আসামিরা পূর্ব শত্রুতার জের ধরে তার ওপর অতর্কিতভাবে হামলা চালিয়ে আহত করে। আসামি মো. জাকির আমার কাছে থাকা নগদ টাকা, মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়। লোকজন এগিয়ে এলে আমাকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে তারা চলে যায়।
এই মামলার আসামিরা হলেন- মো. সুমন (৩৩), মো. রনি (৩১), মো. জামাল (৩৫), মো. রবেল (৩৫), মো. জাকির (২৫), মো. আলানি (২২)।
মামলার বাদী বাবুর বাবা আবদুল মালেক মানিক বলেন, ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সাবেক সহসম্পাদক মোহাম্মদ সুমন। তার নেতৃত্বাধীন বাহিনীর সদস্যরা বস্তিতে মাদক ব্যবসা এবং জুয়া খেলাসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক যুবলীগ কর্মী বলেন, সুমনের হাতে যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও শ্রমিকলীগ নেতারাও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তিনি একেক সময় একেক জনের সঙ্গে চলাফেরা করেন। তার ওঠা-বসা মূলত ছিনতাইকারী ও মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে।
ওই ভুক্তভোগী বলেন, সুমনের কথামতো না চললেই হামলা করে। সিরামিক এলাকায় ছিনতাইকারী ও মাদক ব্যবসায়ী কাউকে কিছু বলা যায় না। বললেই সুমন বলে, ওরা আমার লোক। এ এলকায় আমরা খুব আতঙ্কের মধ্যে আছি।
আরেক ভুক্তভুগী শাহীন বাংলানিউজকে বলেন, মঙ্গলবার (২৪ নভেম্বর) রাত ১১টা ৫৮ মিনিটে সুমন আমাকে ফোন করে হুমকি দিয়েছেন।
শাহিন বলেন, ওদের অত্যাচারে এই এলাকার বাসিন্দারা অতিষ্ঠ। সিরামিক ব্লক-ট এলাকায় রাজন ও বেগুনটিলা এলাকায় আবুল গ্রুপ মাদক ব্যবসা করছে। সুমনের ভায়রা ভাই জামাল আমাদের এলাকায় জুয়ার আড্ডা বাসায়। জুয়া খেলায় বাধা দেওয়ায় আমার সমন্দিকে মারধর করে। এই মারধরের ঘটনায় মামলা করেছি বলেই আমাকে ফোন দিয়ে হুমকি দিয়েছেন সুমন।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাজ্জাদ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, “হামলা ও মামলার বিষয় আমি কিছু জানি না। মাত্র আমি আপনার কাছ থেকে জানতে পারলাম। আমি সুমন নামে কাউকে চিনি না। ঘটনাগুলোতে যেহেতু মামলা হয়েছে, এ বিষয়ে পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ভালো বলতে পারবেন। ”
এ বিষয়ে পল্লবী থানা যুবলীগের সভাপতি ও মহানগর যুবলীগ সাংগঠনিক সম্পাদক এবং ঢাকা উওর সিটি করপোরেশনের ৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তাজুল ইসলাম চৌধুরী বাপ্পি বাংলানিউজকে বলেন, “যদি যুবলীগের কোনো নেতাকর্মী অপরাধ করে থাকে, তাহলে তাদের অপরাধের দায়ভার তাদেরকেই বহন করতে হবে। দল বা সংগঠন বহন করবে না। ”
তিনি আরও বলেন, “আমার জানামতে পল্লবী-রূপনগর থানায় ছয়টি ওয়ার্ড। এই ছয়টি ওয়ার্ড কমিটিতে তার ( মো. সুমন) কোনো পোস্ট পদবী নেই। সে যদি কোনো অপরাধ করে থাকে, তার অপরাধের দায়ভার তাকে নিতে হবে। প্রচলিত আইনে তার বিচার হবে। যুবলীগের কোনো নেতাকর্মীকে কোনো হুমকি বা গায়ে হাত দেওয়া হলে কোনোভাবে আমরা তা বরদাস্ত করব না। ”
পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী ওয়াজেদ আলী বাংলানিউজকে বলেন, “ওই এলাকায় তেমন কোনো ভয়াবহ ঘটনা ঘটেনি। সে তেমন ভয়ঙ্কর আসামি নয়, আমরা তাকে সুযোগও দেইনি। তার প্রতি আমাদের কোনো দুর্বলতাও নেই। দুর্বলতা থাকলে পল্লবী থানায় তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা হতো না। আসামিদের শিগগিরই গ্রেপ্তার করা হবে। ”
সহকারী পুলিশ কমিশনার (মিরপুর-পল্লবী জোন) মো. শাহ কামাল বাংলানিউজকে বলেন, “অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তাকে গ্রেপ্তার করার চেষ্টা চলছে। আমরা আসামির বিষয়ে ওয়াকিবহাল। অল্প সময়ের মধ্যে আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারবো বলে আশা করছি। ”
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৭, ২০২০
এমএমআই/