ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

যে মসজিদে নামাজ পড়েন বাংলাদেশ-ভারতের মানুষ (ভিডিও)

ফজলে ইলাহী স্বপন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০২০
যে মসজিদে নামাজ পড়েন বাংলাদেশ-ভারতের মানুষ (ভিডিও)

কুড়িগ্রাম: কাঁটাতার কখনো-সখনো মানে না আন্তর্জাতিক সীমানার বাধা। হয়তো কাঁটাতারের প্রয়োজনই হয় না।

সব কিছুর ঊর্ধ্বে সেখানে সম্প্রীতি-সৌহার্দ্য। ঘর যার বাংলাদেশে আর রান্নাঘর ভারতের সীমানায়, তার তো উপোস থাকার জো নেই। তেমন যে মসজিদ প্রতিবেশী দুই দেশের জিরো লাইনে সেখানে কে কাকে রুখবে! সেখানে জয়ী সৌহার্দ্য-ভালোবাসা।

ঘর-রান্নাঘরের বিষয়টি রয়েছে সাতক্ষীরার পদ্মশাখরা সীমান্তে। দেশের আরো অনেক সীমান্তবর্তী এলাকায় এমনটি দেখা যায়। কিন্তু কুড়িগ্রামের বাঁশজানি সীমান্তের একটি মসজিদের গল্পটা একটু আলাদা।

কুড়িগ্রাম জেলা শহর থেকে ৫০ কিলোমিটার দুরে ভূরুঙ্গামারী উপজেলার পাথরডুবি ইউনিয়নের বাঁশজানি সীমান্ত। বলা হয় মসজিদটি অন্তত দুইশ বছর আগে নির্মিত। নাম দক্ষিণ বাঁশজানি ঝাকুয়াটারী জামে মসজিদ। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের আন্তর্জাতিক মেইন সীমানা পিলার ৯৭৮ এর সাবপিলার ৯ এস’র পাশে এর অবস্থান। মসজিদটির কিছুটা অংশ ভারতে। তবে বেশির ভাগ অংশ বাংলাদেশের সীমানায়।  

সীমান্তবর্তী স্থানে হওয়ায় মসজিদটির অবকাঠামোগত কোনো উন্নয়ন হয়নি। কখনও সংস্কারের প্রযোজন হলে দুই দেশের মুসল্লিদের দানের টাকায় কোনো রকমে তা সম্পন্ন করা হয়।  

দেশ-বিদেশের অনেক মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে দেখতে আসেন দু’দেশের মানুষের সৌহার্দ্যপূর্ণ ভালোবাসার বন্ধন এ মসজিদটি দেখতে। তারা এখানে এসে স্থানীয়দের সঙ্গে নামাজও আদায় করেন।

প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পাশাপাশি প্রতি শুক্রবার দুই দেশের মানুষের মিলনমেলা বসে এখানে। জুমার দিনে একত্রিত হয়ে নামাজ আদায় শেষে মানবজগতের কল্যাণে করা হয় দোয়া। শুধু তাই নয়, নামাজ আদায় শেষে মানুষের দেওয়া তবারকও ভাগ হয়ে যায় দুই দেশে।  

ভূরুঙ্গামারী উপজেলার পাথরডুবি ইউনিয়নের বাঁশজানি সীমান্তে সরেজমিনে স্থানীয় বয়োঃজৈষ্ঠদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মসজিদটি স্থাপনের ইতিহাস সবাই শুনেছেন বাপ-দাদাদের মুখে মুখে। তাদের দেওয়া তথ্যমতে, ব্রিটিশ আমলে নির্মিত হয় ‘বাঁশজানি মসজিদ’। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তানের ঝাকুয়াটারি গ্রামটি আলাদা করে দেয় দু’টি দেশের মানচিত্র।  

দু’দেশের সীমান্ত এলাকায় পড়ে যায় মসজিদটি। পরবর্তীসময়ে যা বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলার ভূরুঙ্গামারী উপজেলার পাথরডুবি ইউনিয়নের বাঁশজানি সীমান্তর্তী গ্রাম হয়ে যায়। অপরদিকে ভারতের অংশের নাম রাখা হয়ছোট গাড়লঝোড়া। সেসময় ভারতের কোচবিহার জেলার দিনহাটা থানার অধীন এলাকাটি পরে সাহেবগঞ্জ থানার অন্তর্ভুক্ত হয়।

বাঁশজানি গ্রামের সীমান্ত লাগোয়া স্থানীয়রা জানান, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মসজিদটি দুই দেশের মানুষের শান্তির প্রতীক হিসেবে বিরাজ করছে। দেশ ভাগ হলেও এই সীমান্তের মানুষের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করতে পারেনি। দুই দেশের মানুষদের সামাজিক আচার-আচরণে কিছুটা পার্থক্য থাকলেও আন্তরিকতায় কমতি নেই। তারা একসঙ্গে সুখে-দুঃখে পাশে থেকে প্রতিবেশীর মতোই বসবাস করছেন বংশ পরম্পরায়।

বাঁশজানি গ্রামের বাসিন্দা মসজিদের মুয়াজ্জিন নজরুল মিয়া (৬২) বাংলানিউজকে জানান, ছোটবেলা থেকেই তিনি এই মসজিদে বাপ-দাদার হাত ধরে নামাজ পড়তে আসেন। এখন মুয়াজ্জিন হিসেবে আজান দেন। আজানের সঙ্গে সঙ্গে দুই দেশের মানুষ একসঙ্গে মিলিত হয়ে নামাজ আদায় করেন। নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বের হয়ে একে অপরে কুশল বিনিময়ও করেন।
 

স্থানীয় বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম, আহমেদ আলী জানান, গ্রামের মাঝামাঝি কাঁচা সড়কটি অর্ধেক বাংলাদেশের অর্ধেক ভারতের। উভয় দেশের নাগরিক চলাচলের জন্য ব্যবহার করা হয়। কিন্তু কোনো দেশের সরকার মসজিদটির উন্নয়নে হস্তক্ষেপ করে না।  

ভারতের ছোট গাড়লঝোড়া থেকে নামাজ পড়তে আসা খয়বর আলী (৬০) বাংলানিউজকে বলেন, দুইশ বছরের পুরনো মসজিদটি সীমান্ত এলাকায় হওয়ায় কোনো বরাদ্দ আসে না। স্থানীয়রা উদ্যোগ নিলেও আন্তর্জাতিক আইনি জটিলতায় তা বাস্তবায়ন হয়না। দুই দেশের সরকার যৌথভাবে উন্নয়নে এগিয়ে এলে মসজিদটি হতে পারে ঐতিহাসিক একটি দর্শনীয় স্থান।

বাঁশজানি মসজিদ কমিটির সম্পাদক বাংলাদেশ অংশের বাসিন্দা কফিলুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, পূর্বপুরুষ থেকে একই সমাজে আমরা দুই দেশের মানুষ। সীমান্তে চলাচলে কোনো জটিলতা নেই। তবে মসজিদটি পাকারণের জন্য সরকারের সহায়তা চাইলে সীমান্ত জটিলতা সামনে চলে আসে।

বাঁশজানি মসজিদের ইমাম আবুবক্কর সিদ্দিক বাংলানিউজকে বলেন, শুক্রবার জুমার দিনে ভারত-বাংলাদেশের মানুষের আগমনে মসজিদ প্রাঙ্গণ যেমন প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে, তেমনি মসজিদে আসা দুই দেশের তবারক বা মিষ্টান্ন খাওয়া হয় একসঙ্গে। দুই দেশের ছেলে-মেয়েরা আলাদা স্কুলে পড়ালেখা করলেও একসঙ্গে খেলাধুলা করে তারা। ভারত অংশের ৪৫টি পরিবারের আড়াইশ মানুষ বাংলাদেশের শতাধিক পরিবারের সঙ্গে মিশে থাকে আত্মীয়তার বন্ধনে।

ভূরুঙ্গামারী উপজেলার পাথরডুবি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবীর মিঠু বাংলানিউজকে বলেন, আন্তর্জাতিক আইনে সীমান্তে ভবন নির্মাণের সুযোগ নেই। তবে মসজিদের বিষয়টি সেভাবে দেখার জন্য সংশ্লিষ্টদের কাছে অনুরোধ করছি আমরা। মসজিদটি দুই দেশের সীমান্তে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা রোধে দৃষ্টান্ত হতে পারে।  

বাংলাদেশ সময়: ০৯০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০২০
এফইএস/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।