ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

৫ সন্তান নিয়ে শৌচাগারের সেপটিক ট্যাংকের উপর বসবাস

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৫৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০২১
৫ সন্তান নিয়ে শৌচাগারের সেপটিক ট্যাংকের উপর বসবাস

বরিশাল: সৎ মায়ের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে খুব ছোট বয়সে বাবার বাড়ি ত্যাগ করেন সাথী বেগম (৩৫)। সেখান থেকে অর্থাৎ মাদারীপুরের কালকিনি থেকে অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পারি জমাতে গিয়ে বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলা সদরে এসে নিজেকে নোঙর করেন।

এরপর থেকে নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্যদিয়ে ১৮ থেকে ২০ বছর ধরে জীবনযুদ্ধ চালিয়ে গেলেও আজ অব্দি স্থায়ী কোনো ভিটে-মাটির সন্ধান পাননি তিনি। তবে কিশোরী থেকে আজ তিনি পাঁচ সন্তানের জননী, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সন্তানদের লালন-পালনসহ সহযোদ্ধা মানসিক ভারসাম্যহীন স্বামী সোহাগ খানকে দেখভাল করে জীবন কাটাতে হচ্ছে তাকে।

জীবনযুদ্ধে সন্তান-স্বামীকে নিয়ে বেঁচে থাকতে বর্তমানে সাথী বেগমকে কোনোভাবে টিনের বেড়া দিয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছে বাবুগঞ্জ বন্দর বাজারের পাবলিক টয়লেটের (গণশৌচাগার) সেপটি ট্যাংকের ওপর। যেখানে মনুষ্য বর্জ্যের চরম দুর্গন্ধ সয়ে সন্তানের নিয়ে দিনের পর দিন পার করে যাচ্ছেন সাথী দম্পতি।

সাথী বেগম জানান, খুব ছোটবেলায় সৎ মায়ের অত্যাচারে ঘর ত্যাগ করেন। এরপর মাদারীপুরের কালিকিনি থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে চলে আসেন বরিশালের বাবগঞ্জ বন্দর বাজারে। যেখানে এসে প্রথম মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করে বেঁচে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। এর কিছুদিন পর বাগেরহাটের ছেলে সুইপার (মেথর) সুমন খানের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। পরিচয় সূত্র ধরে সোহাগের সঙ্গে সুইপারের কাজেও করেছেন তিনি। কিন্তু বিষয়টি স্থানীয়রা ভালোভাবে নিতে না পেরে অপবাদ দিতে শুরু করেন।

সেই অপবাদ ঘোচাতে সুমনকে বিয়ে করে সংসার গড়েন। শুরুতে বাবুগঞ্জ বন্দর এলাকার সিনেমা হলের আশপাশে থাকলেও সেটি ভেঙে ফেলায়, নতুন আশ্রয় গড়েন বন্দর বাজারের মসজিদ সংলগ্ন একটি খালি জায়গায়। সেখানেই দুইবার ছাপড়া ঘর পাল্টে এখন রয়েছেন পাশের গণশৌচাগারের সেপটিক ট্যাংকের ওপর। অন্যের জায়গায় আশ্রয় না মেলায় এখন এটিই তার আশ্রয়স্থল।
সংসার জীবনে প্রথম সন্তান ১৪ বছরের শাওনকে অভাবের কারণে পড়াশোনা করাতে পারেননি। কিছুদিন আগে পাশের একটি বাড়ি দেখভালের কাজে দেন শাওনকে। বাকিদের মধ্যে ১২ বছরের শান্ত, ১০ বছরের মিম, ৮ বছরের সাগর ও ৬ বছরের ইমন রয়েছেন তার সঙ্গে। সেইসঙ্গে মানসিক ভারসাম্যহীন ও পঙ্গু (এক পা কাটা) স্বামী সোহাগেরও দেখভাল করছেন তিনি।

সাথী বেগমের বর্ণনায়, বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর তিনি যেমন আর গ্রামে ফেরেননি, তেমনি স্বামীর বাড়ি বাগেরহাটেও কখনও যাননি। পাঁচ নম্বরের শিশু সন্তানটি জন্ম নেওয়ার কিছুদিন পর মানসিক সমস্যা দেখা দেয় তার স্বামীর। এককথায় পাগল। এখন তার দিনকাটে বন্দর বাজারের সড়কের সামনে বসে। কারণ কোনো কাজই তিনি করতে পারেন না।

তিনি জানান, বর্তমানে খুবকষ্টে দিন পার করতে হচ্ছে তাদের। আর যে কাজ করেন তাও প্রতিদিন হয় না। কাজ না হলে খাবারের যোগারও হয় না। তখন মানুষের কাছে হাত পেতে খেতে হয়। করোনার মধ্যে স্থানীয় এক সাংবাদিক ভাইয়ের মাধ্যমে মানুষের কাছ থেকে সাহায্য এনে চলেছেন।

সেপটি ট্যাংকের ওপর খুব কষ্টে দিন কাটছে বলে জানিয়ে লামচর ক্ষুদ্রকা‌ঠি সুগন্ধা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী মিম বলেন, ট্যাংকের ওপরসহ বিভিন্ন অংশ ফাটা রয়েছে। যেখানে থেকে খুব দুর্গন্ধযুক্ত গ্যাস বের হয়। রাতে ঘুমাতেও কষ্ট হয়। আর খাওয়া-দাওয়া বাইরে গিয়ে করতে হয়। এ অবস্থায় একটা যদি থাকার ঘর দিতো কেউ। আমাদের জন্য অনেক ভালো হতো।

সরেজমিনে দেখা যায়, গণশৌচাগারের সেপটি ট্যাংকের ওপরের অংশে কোনোভাবে পুরাতন টিন দিয়ে ছাপড়ার ঘর তুলে বসবাস করছেন সুমন-সাথী দম্পতি। জড়াজীর্ণ সেই ঘরের ভেতরে দুই-তৃতীয়াংশে তোষক ফেলে বিছানার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাকি অংশে কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় ও সাংসারিক সামগ্রী রাখা। দিনের বেলা সন্তানরা সে ঘরের মধ্যে না থেকে বাইরেই ঘোরাফেরা করছে। আর এতো কিছুর মাঝেও তাদের কারও মুখে কষ্টের ছাপ নেই। তবে, পাঁচ সন্তান নিয়ে মাথা গোঁজার একটু ঠাঁই চান সাথী।

তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকায় পরিবারটি সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই ভূমিহীন হয়েও প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ঘরের বরাদ্দও পাননি তারা।

এদিকে, শৌচাগারের সেপটি ট্যাংকের ওপর থাকার বিষয়টি সাংবাদিকদের কাছ থেকে জানতে পেরে বুধবার (২৭ জানুয়ারি) বিকেলে সেখানে যান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আমিনুল ইসলাম। এসময় তিনি সাথী বেগমের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাকে সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দেন। তিনি পরিবারটিকে শীতবস্ত্র দেন।

ইউএনও আমিনুল ইসলাম জানান, খোঁজ নিয়ে যতটুকু জানতে পেরেছি তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। কিন্তু ঘর পেতে হলে পরিচয়পত্রের প্রয়োজন। তাই বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। যতদ্রুত সম্ভব পরিবারটির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ২১৪৫ ঘণ্টা, জানুয়া‌রি ২৭, ২০২১
এমএস/ওএইচ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।