ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

মেয়ে হত্যার বিচারের আশায় অসহায় এক বাবা

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৫৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১, ২০২১
মেয়ে হত্যার বিচারের আশায় অসহায় এক বাবা মীম ও তারা বাবা-মা

কুষ্টিয়া: অর্থনীতিতে অনার্স-মাস্টার্স প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ তাসমীম আক্তার মীম। পরিবারের অমতেই নিজের পছন্দে বিয়ে করেছিলেন।

নিজের পায়ে দাঁড়াতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে। কিন্তু তার আগেই ঘাতক স্বামী ও শাশুড়ির নির্মম হিংস্রতার শিকার হয়ে জীবনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে গেলো মীম।  

একমাত্র মেয়ের শোকে কাতর স্কুল শিক্ষক বাবা মহিবুল আলম এভাবেই খেদোক্তি করলেন। বললেন, আমি এখন বিচারের অপেক্ষায় দিন গুনছি, খুনিদের গ্রেফতার দাবি করছি।

গৃহবধূ মীমের বাবার অভিযোগ, ঘটনার শুরু থেকেই কোনো কিছু সত্য-মিথ্যার বাছ-বিচার না করেই ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে চালাতে চেয়েছে দৌলতপুর থানা পুলিশ। গত বছর ০১ সেপ্টেম্বর বিকেলের ঘটনায় লিখিত এজাহার নিয়ে সন্ধ্যার দিকে দৌলতপুর থানায় গেলে সেখানে ওসি/তদন্ত পুলিশ পরিদর্শক নিশিকান্ত আমাকে বলেন, ‘আপনার মেয়ে আত্মহত্যা করেছে, এখানে আমাদের কিছু করার নেই’। এই বলে ফিরিয়ে দেন আমাকে’। অথচ মীমের ওপর ঘটে যাওয়া নির্মম নির্যাতনের সত্য-মিথ্যা তদন্ত করেও দেখলেন না পুলিশ। দীর্ঘ ১৪ দিন ঢাকা মেডিক্যালে মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে হেরে যাওয়া মীমের সুরৎহাল রিপোর্টে শাহবাগ থানা পুলিশ নির্যাতনে মৃত্যুর প্রাথমিক কারণ উল্লেখ করেন। একইভাবে গত ১৯ নভেম্বর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান প্রফেসর ডা. সোহেল মাহমুদ স্বাক্ষরিত ময়নাতদন্ত রিপোর্টে সুষ্পষ্টভাবে এটাকে হত্যাকাণ্ড হিসেবে নিশ্চিত করেছেন।

একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে ক্যানসার আক্রান্ত মীমের মা তাজমা খাতুন অভিযোগ করেন, ‘মীমের মৃত্যুর একদিন পর ১৫ সেপ্টেম্বর দৌলতপুর থানা পুলিশ হত্যা মামলা রেকর্ড করলেও এখন পর্যন্ত ঘটনার সাড়ে ৪ মাসের মধ্যেও মামলার তদন্তে নানাভাবে গড়িমসি করছেন। হত্যাকাণ্ডে জড়িত মীমের স্বামী দৌলতপুর উপজেলার তাড়াগুনিয়া গ্রামের মৃত. জিন্না মোল্লার ছেলে এজাজ আহমেদ বাপ্পী এবং শাশুড়ি কোহিনুর বেগমকে গ্রেফতার করেনি পুলিশ।  

তিনি বলেন, আমি বেঁচে থাকতে মেয়ে হত্যার বিচার দেখে যেতে চাই’।

তাজমা খাতুন বলেন, বিয়ের পর মাস না পেরোতেই মীম তার স্বামী-শাশুড়ির আসল চেহারা দেখতে পায়। আমরা বিষয়টা জানার পর মীমকে বলেছিলাম ওখান থেকে চলে আয়। কিন্তু মীম বলেছিলো, ‘মা মেয়েদের বিয়ে তো একবারই হয়, তোমরা আমাকে অন্য কোথাও বিয়ে দিলে সেখানেও যে আমি সুখী হবো এমন কোনো গ্যারান্টি নাই, বরং এখানেই চেষ্টা করে দেখি এরা পরিবর্তন হয় কি না’। একমাত্র মেয়ের সুখের জন্যে বিয়ের পর নগদ টাকাসহ অন্তত ১০ লাখ টাকার উপহার দিয়েছি অথচ দাবিকৃত মোটরসাইকেলটি দিতে না পারায় নির্যাতন চলছিলো মীমের ওপর। এর সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছিলো শাশুড়ি কোহিনুর বেগমের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় দেখে ফেলায়।  

এতে আরও একটি নতুন জটিলতার সৃষ্টি হয়। ঘটনার দিন স্বামীর নির্যাতন ও শাশুড়ির অকথ্য ভাষায় আমাদের উদ্দেশ্যে গালি গালাজ করার জবাবে মীমও তার শাশুড়ির চরিত্র তুলে কথা বলেছিলো যা আমি সংযোগে থাকা মোবাইল ফোনে শুনতে পায়। এসময় স্বামীর সঙ্গে শাশুড়িও নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে মীমকে।

নিহত মীমের মামা এমএম মুন্না দাবি করেন, ‘মীম হত্যা মামলার আসামি এজাজ আহমেদ বাপ্পী নিয়মিত ফেসবুকসহ বিভিন্ন স্যোস্যাল মিডিয়ায় এক্টিভ দেখছি। তার ফোনও মাঝে মধ্যে খোলা পাওয়া যায় অথচ পুলিশ নাকি আসামির কোনো সন্ধানই পাচ্ছে না। আজকের যুগে তথ্যপ্রযুক্তির এতো অপশন থাকতেও পুলিশ তাদের অবস্থান শনাক্ত করতে পারে না এটা কেউ বিশ্বাস করবে? 

মানবাধিকার কর্মী তাজনিহার বেগম বলেন, ‘আমরা কোন পরিস্থিতিতে জীবন-যাপন করছি বুঝতে পারছিনা, যেকোনো ধরনের হত্যাকাণ্ড বা সহিংস ঘটনার ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা অর্পিত দায়িত্ব হিসেবেই তার সুষ্ঠু তদন্ত করবেন, এবং ন্যায় বিচার নিশ্চিত করবেন, এটাই আইন, অথচ নারীর ওপর সংঘটিত সহিংসতার পর সেটাকে নানাভাবে ভিন্ন খাতে ঠেলে দেয় পুলিশ। এটা খুব দুঃখজনক। গৃহবধূ মীম হত্যাকাণ্ডের শুরু থেকেই পুলিশের নানা অবহেলা ও গড়িমসির অভিযোগ করে আসছেন তার পরিবার। এই হত্যাকাণ্ডের সাড়ে ৪ মাস অতিক্রম হলেও এর কোনো কুলকিনারা করতে পারেনি পুলিশ। না তদন্ত কাজের শেষ, না জড়িতদের গ্রেফতার। ইতোমধ্যে জেলার বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ ও ন্যায় বিচারের দাবিতে একাধিকবার মানববন্ধন করা হয়েছে। কিন্তু তাতেও কিছু হচ্ছে না। অবিলম্বে জড়িতদের গ্রেফতার ও হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য উদঘাটনসহ চার্জশিট দেওয়ার দাবি করেন এই মানবাধিকার কর্মী।

এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দৌলতপুর থানার উপ-পরিদর্শক অরুন কুমারের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

তবে দৌলতপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি/তদন্ত) সাহাদত হোসেনের কাছে মীম হত্যা মামলার তদন্তে অগ্রগতি বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মীম হত্যা মামলার সুরৎহাল ও ময়নাতদন্ত রিপোর্ট আমরা পেয়েছি। এটা যেহেতু মার্ডার, তাই আসামি ধরার চেষ্টা হচ্ছে। আসামির কাছ থেকেও আমাদের জানতে হবে কিভাবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। সে কারণে চার্জশিট দিতেও একটু দেরি হচ্ছে। আশাকরি খুব শিগগিরই আসামি ধরতে পারব।

বাংলাদেশ সময়: ২১৫৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০১, ২০২১
আরএ  

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।