ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

কেনার পর পণ্য বা টাকা চাইলে চলতো মারধর

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩০৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০২১
কেনার পর পণ্য বা টাকা চাইলে চলতো মারধর

ঢাকা: ফাল্গুনী শপ ডট কম নামে অনলাইনে পরিচালিত প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য কিনে প্রতারিত হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। দীর্ঘদিনেও কেনা পণ্য না পেয়ে প্রতিষ্ঠানটির অফিসে পণ্য বা টাকা চাইতে গেলে উল্টো টর্চার সেলে নিয়ে মারধর করা হতো ভুক্তভোগীদের।

অস্ত্র দেখিয়ে ভয়ভীতি দেখানো ছিল নিয়মিত ঘটনা। এর বাইরে অফিসের নিজস্ব টর্চার সেলে নিয়ে লাঠিপেটা, বৈদ্যুতিক শকসহ অন্যান্য শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে অফিস থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হতো পাওনাদারদের।

কয়েকজন ভুক্তভোগীর অভিযোগের ভিত্তিতে বুধবার (২৪ নভেম্বর) বিকেল থেকে বৃহস্পতিবার (২৫ নভেম্বর) দুপুর পর্যন্ত রাজধানীর বনশ্রী এলাকায় অভিযান চালিয়ে ফাল্গুনী শপের সিইও মো. পাভেল হোসেন (৩০) ও তার তিন সহযোগীকে গ্রেফতার করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব-৪)।

গ্রেফতার অন্যরা হলেন- মো. সাইদুল ইসলাম (৪০), আব্দুল্লাহ আল হাসান (২৫) ও মোছা. ফারজানা আক্তার মিম (২১)।

এ সময় তাদের কাছ থেকে ১টি বিদেশি পিস্তল, ১টি ম্যাগজিন, ২ রাউন্ড গুলি, ২৪ ক্যান বিয়ার, ৪ বোতল দেশি মদ, ১টি প্রাইভেটকার, কম্পিউটার, প্রিন্টার, বিপুল পরিমাণ এন-৯৫ মাস্ক, ১০০টি ইনভয়েস, ৩০ চেকবহ, ৮০টি সিল ও বিপুল পরিমাণ বিজ্ঞাপনের স্ক্রিনশট উদ্ধার করা হয়।

র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মোজ্জাম্মেল হক বলেন, ফাল্গুনী শপ কারসাজির মূলহোতা পাভেল হোসেন, যিনি প্রতিষ্ঠানটির সিইও। এছাড়া গ্রেফতার সাইদুল ইসলাম, আব্দুল্লাহ আল হাসান ও ফারজানা আক্তার মিম তার অন্যতম সহযোগী ছিলেন।

কে এই পাভেল

পাভেল ১৯৯১ সালে গোপালগঞ্জ সদর থানা এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। ৮ ভাই-বোনের মধ্যে চতুর্থ পাভেল বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছেন বলে জানা গেছে। তিনি ২০০৯ সালে এইচএসসি অধ্যয়নরত অবস্থায় অস্ত্রসহ র‌্যাবের কাছে আটক হয়েছিলেন এবং তার নামে তেজগাঁও থানায় একটি অস্ত্র মামলা রয়েছে।

২০১৪ সালে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করার পর 'লার্নি অ্যান্ড আর্নিং' নামে একটি প্রজেক্টে রাজবাড়ীতে ৩০-৪০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি শুরু করেন। পরে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের একজন ঠিকাদার হিসেবে কাজ করার সময় তার পরিচিত একজন তাকে অনলাইন ব্যবসা করার পরিকল্পনা দেয়।

২০১৯ সালের শুরুতে পাভেল দিদারুল আলম, কানিজ ফাতেমা ও রহমতুল্লাহ শওকত মিলে ফাল্গুনী শপের নামে একটি অনলাইন বিজনেস প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে। শুরুতে তারা উত্তরা এলাকায় একটি ভাড়া অফিসে আউটলেট খুলে ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করে।

পাভেল নিজে একজন মাদকসেবী। তিনি অনলাইন ব্যবসারা আড়ালে মাদক ব্যবসাও পরিচালনা করতেন বলে জানা গেছে।

শুরু থেকেই চলে পাভেলের প্রতারণা

ব্যবসার শুরুতেই অন্য অংশীদারা পাভেলের এই গ্রহক ঠকানোর বিষয়টি বুঝতে পারে। পরে তারা পাভেলের বিরুদ্ধে থানায় জিডি করেন এবং এফিডেবিট করে উকিল নোটিশ পাঠিয়ে যৌথ ব্যবসা থেকে সরে যান। তারা এ বিষয়টি জয়েন্ট স্টক অথোরিটিকেও অবহিত করেন। এরপরও পাভেল তাদের নামে জাল সিল-সই ব্যবহার করে গ্রাহকদের প্রতারিত করতেন। এমনকি তাদের নাম ব্যবহার করে যৌথ নামে চেক পর্যন্ত ইস্যু করতেন।

জেল থেকে বেরিয়ে আরো বেপরোয়া পাভেল

চলতি বছরের মে মাসে প্রতারণার অভিযোগে কয়েকজন গ্রাহক পাভেলের নামে উত্তরা পশ্চিম থানায় প্রতারণার মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় পাভেল সিআইডি কর্তৃক গ্রেফতার হয়ে ২১ দিন জেলে ছিলেন। জামিনে বের হয়ে তিনি আগের চেয়েও বেপরোয়া হয়ে উঠে। এর মধ্যে কিছু গ্রাহক ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরে অভিযোগ করলে একাধিকবার ফাল্গুনী শপের আউটলেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে জুলাই মাসে পাভেল বনশ্রী এলাকায় 'অরিমপো.কম' ও 'টেক ফেমিলি.কম' নামে নতুন অফিস করে আড়ালে ফাল্গুনী শপের কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকেন। 'অরিমপো.কম' ও 'টেক ফেমিলি.কম' নামে দুটি প্রতিষ্ঠানে পাভেল নিজে এমডি এবং তার স্ত্রী রিতা আক্তার চেয়ারম্যান হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করে।

ফাল্গুনী শপের প্রতারণার কৌশল

এই চক্রটি করোনায় লকডাউন চলাকালীন সময়ে অনলাইনে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী স্বল্প মূল্যে বিক্রির চটকদার বিজ্ঞাপন প্রচার করতো। বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে ক্রেতারা যোগাযোগ করে বিপুল পরিমাণ অর্ডার দিতে থাকেন। পরে প্রতারক প্রতিষ্ঠানটি কিছু কিছু ক্রেতাকে আংশিক, কিছু কিছু ক্রেতাকে নিম্নমানের পণ্য আবার কিছু কিছু ক্রেতাদের কোনো পণ্য সরবরাহ না করেই টাকা আত্মসাৎ করে।

যেসব ক্রেতা এই অনলাইন শপের পণ্য অর্ডার করতো তাদেরকে ওই পণ্যের টাকা অগ্রিম পরিশোধ করতে বলা হতো। তখন সাধারণ লোকজন মোবাইল ব্যাংকিং ও অনলাইন গেটওয়ের মাধ্যমে পণ্যে টাকা অগ্রিম পরিশোধ করতেন। সে পরবর্তীতে মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট ও অনলাইন গেটওয়ে থেকে টাকা অন্যত্র স্থানান্তর করে বা জমি-প্লট কিনে টাকা লেয়ারিং করা হতো।

টাকা পাওয়ার পরর পাভেল ও তার সহযোগীরা ক্রেতাদের সঙ্গে আর কোন যোগাযোগ করতো না। এভাবে তারা প্রচুর পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়ে আত্মসাৎ করেছে। প্রতারণার আরেক কৌশল হিসেবে কোন নোটিশ ছাড়াই তার অফিসের ঠিকানা পরিবর্তন করে। যাতে প্রতারিত গ্রহক অফিসে এসে কোন অভিযোগ করতে না পারেন।

৪ কোটি টাকা লেনদেন, অ্যাকাউন্টে আছে ১৫ লাখ

বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে ১০-১২ জন কর্মচারী রয়েছে যাদেরকে মাসিক আড়াই থেকে তিনলাখ টাকা বেতন পরিশোধ করা হয়। ফাল্গুনী শপের নামে কোন ব্যাংক হিসাব নেই, পাভেলের ৪টি বিভিন্ন ব্যাংকে নিজস্ব অ্যাকাউন্টে বর্তমানে প্রায় ১৫ লাখ টাকা রয়েছে। অথচ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সাল থেকে তার নিজস্ব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রায় ৪ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে।  

অফিসে টর্চার সেল

অভিযানের সময় পাভেলের ওই প্রতিষ্ঠানের অফিসে টর্চার সেলের তথ্য পায় র‌্যাব। তার কাছে কোন ভুক্তভোগী পণ্য অথবা টাকা চাইতে তাদেরকে পণ্য বা টাকা না দিয়ে অস্ত্র দেখিয়ে বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখানো হতো। এছাড়া তার টর্চার সেলে লাঠিপেটা, বৈদ্যুতিক শকসহ অন্যান্য শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে অফিস থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হতো ভুক্তভোগীদের।

র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মোজ্জাম্মেল হক বলেন, পাভেলের নামে ফাল্গুনী শপ বিডিসহ সর্বমোট ২৮টি নামসর্বস্ব কোম্পানির সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ফাল্গুনী শপ. কম ছাড়া বাকি ২৭টি কোম্পানির কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।

পাভেল অত্যন্ত ধূর্ত প্রকৃতির, তিনি অনলাইন শপের নামে কোন ব্যাংক হিসাব না খুলে তার নিজস্ব ব্যাংক হিসাবে ক্রেতাদের টাকা গ্রহণ করে অন্যত্র স্থানান্তর বা জমি/প্লট কিনে টাকা লেয়ারিং করত। ওই অনলাইন শপের সিইও পাভেল নিজে এবং তার স্ত্রী পলাতক আসামি রিতা আক্তার (২৬) তার অন্যতম ব্যবসায়িক পার্টনার। বর্তমানে তার স্ত্রী রিতা আক্তার 'টেক ফ্যামিলি.কম' সহ আরো ৭-৮টি কোম্পানি খোলার পাঁয়তারা করছে বলে জানা গেছে।

গ্রেফতারদের বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক ও প্রতারণার মামলা দায়েরের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। এছাড়া জড়িত অন্যদের গ্রেফতারে র‌্যাবের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ০৩০৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০২১
পিএম/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।