ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

লঞ্চের অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র কি আদৌ কাজে এসেছিল

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০২১
লঞ্চের অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র কি আদৌ কাজে এসেছিল

বরিশাল: রাজধানীসহ দক্ষিণাঞ্চলের এক জেলা থেকে অন্য জেলার যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছোট-বড় আকারের নৌযান। বিশেষ করে বড় আকারের বিলাসবহুল লঞ্চগুলো বেশ জনপ্রিয় ঢাকা থেকে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন রুটে যাতায়াতকারীদের মধ্যে।

তবে, শুক্রবার (২৪ ডিসেম্বর) ভোরে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের পর নৌযাত্রীদের মধ্যে নতুন করে শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে।  

এ ঘটনার পর থেকে এখন প্রশ্ন উঠেছে যাত্রীদের নিরপত্তার বিষয়টি নিয়ে। কেউ বলছেন, আধুনিক অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র থাকলে এমনটা হত না, আবার কেউ বলছেন, সরঞ্জাম থাকলেও তার সঠিক ব্যবহার না জানায় তা কোন কাজে আসেনি।

লঞ্চটিতে একেবারে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ছিল বলা যাচ্ছে না বা পুড়ে যাওয়া ফায়ার এক্সটিংগুইসারগুলো দেখে বোঝা যায়। যদিও প্রকারভেদ অনুযায়ী সেই এক্সটিংগুইসারগুলো কতটা কাজের ছিল তা নিয়েও প্রশ্ন করেছেন যাত্রীরা।

কারণ বৈদ্যুতিক লাইনে বা যন্ত্রপাতিতে আগুন ধরলে কার্বন ডাই-অক্সাইড বা ড্রাইকেমিক্যাল পাউডারের এক্সটিংগুইসার প্রয়োজন আর তেল জাতীয় পদার্থের আগুনে ফোমটাইপ ফায়ার এক্সটিংগুইসার প্রয়োজন বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। সেসঙ্গে শুকনো বালু, ভেজা মোটা কাপড় বা চটের বস্তাও কাজে আসতে পারে। এ ঘটনার পর পুড়ে যাওয়া লঞ্চে ঘুরে নিচতলা ও তিনতলায় মোট পাঁচটি এক্সটিংগুইসার দেখা গেলেও সেগুলো মূলত কিসের তা বোঝা যায়নি।

এদিকে পুড়ে গেলেও নিচতলার একটি ও তিনতলার মাস্টার ব্রিজে থাকা একটি এক্সটিংগুইসারের সেফটি পিন ঠিকঠাকভাবেই ছিল, তার মানে সেগুলো ব্যবহার হয়নি। এছাড়া লঞ্চে রিজার্ভ সোর্স থেকে আগুন নেভানোর জন্য পানি আনার ব্যবস্থা, বালু-পানি বহনের বালতিও দেখা যায়নি। তবে, নিচতলার ডেকে দুই পাশে দুটি হস্তচালিত পাম্প দেখা গেছে। যেগুলোর কোনটি কিভাবে ওই রাতে কাজে এসেছিল স্টাফরা পলাতক থাকায় প্রতক্ষ্যদর্শীরাও বলতে পারেনি।

যদিও যাত্রী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, লঞ্চটি দ্বিতীয় দফায় তীরে আসার পর লঞ্চের স্টাফরা কোন ধরনের সহায়তা না করে নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে চলে যায়।

ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীর দক্ষিণ তীরের দিয়াকুল এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, আগুনের ভয়াবহতা এতোই ছিল যাত্রীদের থেকে বেশি আতঙ্কে ছিলেন লঞ্চের স্টাফরা। তারা লঞ্চটিকে কোনরকম না বেঁধেই সেখান থেকে সটকে পড়েন।

আর লঞ্চের যাত্রী রাশেদ বাংলানিউজকে জানান, ঢাকা থেকেই লঞ্চে প্রচুর যাত্রী ছিল। বাধ্য হয়ে লঞ্চের শেষের দিকটাতে বসতে হয়েছে। আর আমাদের পেছনেই ছিল ইঞ্জিন রুম। নলছিটির কোন এক জায়গাতে বসেই ইঞ্জিন রুমকে কেন্দ্র করে আগুনের সৃষ্টি, ঘটনাস্থলে কাউকে যেতে না দেওয়া হলেও স্টাফরা নানানভাবে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আগুনের মাত্রা বেড়ে যায়।

তিনি বলেন, স্টাফদের কেউ আগুন নেভানোর কাজে অভিজ্ঞ নয়, পাশাপাশি পর্যাপ্ত অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রও সেখানে ছিল কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। নাহলে ধীরে ধীরে কিভাবে কোন জায়গা থেকে আগুন গোটা লঞ্চে ছড়িয়ে পড়েছে তা কেউই বুঝতে পারেনি।

লঞ্চের আরেক যাত্রী আহত কালু মিয়া বলেন, ইঞ্জিন রুমের পাশেই কিছু ব্যারেলে তেল ছিল, আগুনের ভয়াবহতা বেড়ে গেলে সেগুলোতেও আগুন লেগে যায়। তারপর তো সব পুড়ে অঙ্গার হতে থাকে। মানুষজন সাঁতার জানুক বা নাই জানুক কেউ নদীতে লাফিয়ে রক্ষা পেয়েছে, আর কেউ আগুনে পুড়েই মৃত্যুবরণ করেছে।

আহত কালু মিয়ার দাবি, আগুন নেভানোর কাজে পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি ও দক্ষ লোক থাকলে এর ভয়াবহতা এতো হতো না, শুরুতেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা যেত।

এদিকে সূত্র বলছে, বড় ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠান, মার্কেট, বহুতল ভবনে অগ্নি নির্বাপক সরঞ্জাম যথাযথ সংযুক্তি নিশ্চিতকরণ ও এর ব্যবহারের ওপরে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স। এতে করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে কিছু প্রশিক্ষিত লোক তৈরি হয় যাতে আগুন লাগলে তা নেভানোর কাজে সাহসিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে পারে। তবে, বড় বড় নৌযানের ক্ষেত্রে এটা কতটা কার্যকর তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

বরিশাল-ঢাকা রুটের একটি লঞ্চের ম্যানেজার জানান, লঞ্চে প্রশিক্ষিত ফায়ার ফাইটার রাখার জন্য বন্দর কর্মকর্তার আমলে একবার প্রশিক্ষণ দিতে বরিশাল নদী বন্দরে এসেছিল ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। কিন্তু এরপরে আর কোন প্রশিক্ষণে অংশ নিতে পারেনি। আর ওইসময়কার প্রশিক্ষণে তারা কিভাবে আগুন লাগলে কি করতে হয়, কিভাবে যন্ত্রপাতি চালাতে হয় তা জেনেছিলেন। আর ঢাকা-বরগুনাগামী লঞ্চের স্টাফরা বলছেন, তারা শুধু এক্সটিংগুইসারের সেফটি পিন খুলে সেটা কিভাবে আগুনের ওপর প্রয়োগ করতে হয় তা জানেন, এর বাহিরে কোন ধরনের আগুনে কি ব্যবহার করতে হয় তা জানেন না।

আর সাধারণ যাত্রীরা বলছেন, ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে নিয়মিত লঞ্চে বা নৌযানে প্রশিক্ষণ মহড়া চালানো হলে যেমন স্টাফদের মধ্যে প্রশিক্ষিত ফায়ার ফাইটার তৈরি হবে, তেমনি ওইসব নৌযানের যন্ত্রপাতি হালনাগাদ ও সচল রয়েছে কিনা তাও বোঝা যাবে।

এদিকে নৌযানটিতে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ছিল কিনা তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মো. তোফায়েল ইসলামকে এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, সবকিছুই আমরা দেখেছি, আর তদন্ত প্রতিবেদনে সবকিছুই উল্লেখ থাকবে। তার আগে কিছু বলা সম্ভব হচ্ছে না।

বাংলাদেশ সময়: ১৪২০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০২১
এমএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।