ঢাকা, সোমবার, ১৪ শ্রাবণ ১৪৩১, ২৯ জুলাই ২০২৪, ২২ মহররম ১৪৪৬

জাতীয়

বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিনের সঙ্গে আমারও মৃত্যু হতে পারতো!

মাহবুবুর রহমান মুন্না, ব্যুরো এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৬, ২০২২
বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিনের সঙ্গে আমারও মৃত্যু হতে পারতো! বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ আজিজ ।

খুলনা: ‘বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিন আর আমি একই জাহাজে ছিলাম। শত্রুপক্ষের জঙ্গি বিমান জাহাজে বোমা নিক্ষেপ করে।

সেই বোমায় জাহাজে আগুন ধরে যায়। আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যান বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিন। সেদিন তার সঙ্গে আমারও মৃত্যু হতে পারতো। ’

আবেগ তাড়িত হয়ে স্মৃতিচারণ করে এ কথাগুলো বলেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ডেন্টাল সার্জন ডা. এম এ আজিজ (৭২)।

২৬ শে মার্চ (শনিবার) সকালে খুলনা মহানগরীর বয়রার সেমিপাকা কলোনিতে নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত পেটি অফিসার ডা. এম এ আজিজের সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. এম এ আজিজ বলেন, ভারত সরকার বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীকে কলকাতা বন্দরে গার্ডেনরিচ ডক ইয়ার্ডে দুইটি গানবোট উপহার দেয়। সেখানে প্রতিটি বোটে কানাডীয় ধরনের দুটি বাফার গান ও মাইন পড লাগিয়ে এবং ব্রিটিশ ধরনের ৫০০ পাউন্ড ওজনের ৪টি মার্কমাইন বহনের উপযোগী করে গানবোটে রূপান্তর করা হয়। গানবোটগুলোর নামকরণ করা হয় ‌‘পদ্মা’ ও ‘পলাশ’। একাত্তর সালের ১২ অক্টোবর কলকাতার মেয়র প্রফুল্ল কুমার ঘোষ গার্ডেন রিচ জেটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে গানবোট দুটি পানিতে ভাসান। ৮ ডিসেম্বর ভারতের ২৪পরগুনা জেলার টাকি থানার অধিনে হাসনাবাদ একটি নৌবন্দর আছে। সেই নৌবন্দর থেকে পদ্মা ও পলাশ নিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করি। পলাশ গানবোটের আর্টিফিসার পদে ছিলেন রুহুল আমিন আর পদ্মায় ছিল আফজাল হোসেন। আমি বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিনের সঙ্গে ছিলাম। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর খুলনার রূপসা নদীতে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বহনকারী যুদ্ধ জাহাজ পলাশের ইঞ্জিনরুমের দায়িত্ব পালন করছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিনের। হাসনাবাদ হয়ে রূপসা শিপইয়ার্ডের কাছে নদীতে অবস্থান করছিল জাহাজ দুটি। এ সময় জানতে পারি শিপইয়ার্ড এলাকায় পাকিস্তানি হানাদাররা অবস্থান করছে। আমরা তাদের আক্রমণ করি। শিপইয়ার্ডের ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হলো। শত্রুপক্ষের দুটি জঙ্গি বিমান জাহাজ দুটির ওপর বোমা নিক্ষেপ করে। সেই বোমায় জাহাজ দুটিতে আগুন লেগে যায়। জাহাজ দুটিতে থাকা অনুমানিক ৩৫-৪০ জন যে যেভাবে পারে নদীতে ঝাঁপ দেয়। কিন্তু অসীম সাহসী বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিন তারপরও চেষ্টা চালিয়ে যান পলাশকে বাঁচানোর। তবে, ইঞ্জিন বিকল হয়ে আগুন ধরে যায়। অবশেষে পলাশের ধ্বংসাবশেষ পিছে ফেলেই আহত  বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিন ঝাঁপিয়ে পড়েন রূপসা নদীতে। এ ঘটনায়  বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিন ছাড়া আরও মারা যায় শহীদ আক্তার উদ্দিন, শহীদ ফরিদ, শহীদ দৌলত, শহীদ মহিবুল্লাহসহ আরও অনেকে। দুই জাহাজেই কোন রাডার ছিল না।

তিনি আরও বলেন, নদীতে সাঁতার কাটতে কাটতে আমি আর আমার এক সহযোদ্ধা নোয়াখালীর ক্যাপ্টেন ইসহাক বটিয়াঘাটায় ভারতীয় বিএসএফের উদ্ধারকারী জাহাজের কাছে গেলাম। তারা আমাদের টেনে তুললো। তাদের মাধ্যমে আমরা আবার ভারতের হাসনাবাদে চলে গেলাম। আমরা একে অপরের কথা কেউই তেমন বলতে পারি না। পরে যারা জানে তারা এক একজন এক এক রকম কথা বলে। সেই জাহাজ দুটিতে থাকা অনেকেই লবণচরায় নদীর ঘাটে সাঁতরে উঠে তাদের রাজাকাররা ধরে নিয়ে খুলনা জেলা কারাগারে আটকে রাখেন।

মুক্তিযুদ্ধে কীভাবে অংশ নিয়েছেন জানতে চাইলে বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজ বলেন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণের সময় আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। সেই ভাষণের দৃশ্য আমার এখনও চোখে ভাসে। ৮ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে নিজ গ্রাম কুষ্টিয়ায় পান্টি গ্রামে চলে এসে স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কুষ্টিয়া শহরে সম্মুখ যুদ্ধে নেমে পড়ি। নয় নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর মোহাম্মদ আবদুল জলিলের অধিনে যুদ্ধ করি।

ব্যক্তিজীবন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১৯৬৪ সালে নৌবাহিনীতে যোগদান করি। ১৯৬৮ সালে করাচী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনে জিন্নাহ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কলেজ থেকে ডেন্টাল সার্জারিতে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি অর্জন করি। ১৯৭১ সালে নৌবাহিনী থেকে ছুটিতে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিই। কোন কিছু পাওয়ার আশায় যুদ্ধ করিনি শুধুমাত্র দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। দুই ছেলে ও মেয়ের মধ্যে ছেলে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। মেয়েটি গৃহিনী। ছেলেমেয়েদেরও আর্থিক অবস্থা ভালো না। আমি স্ত্রীকে নিয়ে থাকি।

আক্ষেপ করে বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজ বলেন, স্বাধীনতা লাভের ৫০ বছর পরেও আমার কোন স্থায়ী ঠিকানা নেই। আমার কোন ভূমি বা বাড়ি নেই। যে বাসায় থাকি তাও ভাড়া বাসায়। মাথা গোঁজার স্থায়ী ঠিকানার জন্য দপ্তরে দপ্তরে আকুতি-মিনতি জানিয়েও কোনো লাভ হয়নি। নৌবাহিনীর তালিকা থেকে আমি বীর মুক্তিযোদ্ধা। শুধু সনদ আর ভাতা ছাড়া আমি কিছুই পাইনি। রাষ্ট্রীয়ভাবে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে যেসব অনুষ্ঠান হয় সেখানে দাওয়াতও দেওয়া হয় না। মুক্তিযোদ্ধাকালীন অনেক ঐতিহাসিক ছবি, পেপার, তথ্য ও উপাত্ত আমার কাছে সংগ্রহীত রয়েছে। এক বুক কষ্ট আর অভিমান নিয়ে এখন দিনযাপন করছি।

বাংলাদেশ সময়: ১৪০৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৬, ২০২২
এমআরএম/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।